তার নাম শ্রী হরিদাস চন্দ্র। এক সময় এলাকায় তাকে ডাকা হতো ‘হরিদাস পাল’ হিসেবে। পরে নিজের নাম ও ধর্ম পাল্টে হয়ে যান তাওহীদ (৩৪)।
তার গ্রামের বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার একটি ছবি এডিট করে সংযুক্ত করেন। তখন থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নাম ভাঙিয়ে কীভাবে অর্থ উপার্জন করা যায় তার ফন্দি-ফিকির করতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসার পরিচয়ে বদলি বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি ও প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।
অবশেষে এ চক্রের মূলহোতা হরিদাস চন্দ্রকে সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সহযোগিতায় সোমবার রাতে রাজধানীর বনানী থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩ এর একটি দল। র্যাব জানায়, হরিদাস প্রতারণার মাধ্যমে মাত্র ৮ বছরে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। ২০১০ সালেও রাজধানীর উত্তরায় পুরাতন এসি মেকানিকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন শ্রী হরিদাস চন্দ্র তরনীদাস ওরফে তাওহীদ। ২০১৮ সালে সবজি বিক্রেতা ছিলেন। ২০১৯ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে হরিদাস চন্দ্র থেকে তাওহীদ ইসলাম নাম ধারণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার প্রতারণা।
মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, এক শ্রেণির প্রতারক চক্র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ব্যবহার করে বা তাদের প্রটোকল অফিসার বা বিভিন্ন মন্ত্রীর ভুয়া এপিএস পদবি ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে এবং অর্থ আত্মসাৎ করছে। এমনকি প্রতারক চক্র প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের ভুয়া প্রটোকল অফিসার পরিচয় দিয়েও বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করছে। র্যাব জানায়, এমন তথ্যের ভিত্তিতে এনএসআই ও র্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে তাওহীদ ও সহযোগী ইমরান মেহেদী হাসানকে (৩৮) গ্রেপ্তার করা হয়।
তিনি আরো বলেন, ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে অবৈধ উপায়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আত্মীয়ের বাসায় যান তৌহিদ। সেখানকার পঞ্চায়েত প্রধানের কাছ থেকে এতিম সার্টিফিকেট নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন ও ইলেক্ট্রনিক বিষয়ে দুই বছরের বিশেষ প্রশিক্ষণ নেন। ২০১০ সালে দেশে ফিরে রাজধানীর উত্তরায় পুরনো এসি মেকানিকের কাজ শুরু করেন। ২০১৮ সালে সবজি বিক্রেতার সঙ্গে সাবলেট বাসা ভাড়া নেন। সেখানেই বিয়ে ও ২০১৯ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে তাওহীদ ইসলাম ধারণ করেন। তার শ্বশুরের পরিচয়ে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া এলাকায় কিছু জমি ক্রয় করেন। শ্বশুরের মাধ্যমে এলাকার লোকের সঙ্গে নিজেকে একজন বিত্তশালী লোক হিসেবে পরিচিত করান। পাশাপাশি প্রচার করতে থাকেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের প্রটোকল অফিসার। দামি গাড়ি হাঁকিয়ে এবং পোশাক পরিধান করে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, গণ্যমান্য বিত্তশালী ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে তোলেন। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর থেকে অর্থ এবং উন্নয়নমূলক কাজের সম্পন্ন করতে তাদের আশ্বস্ত করতেন।
তার প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে অনেকে চাকরি, বদলি, টেন্ডারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তদবির নিয়ে তার কাছে আসা শুরু করেন। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি চাকরি প্রত্যাশী, পছন্দমতো জায়গায় বদলি, সরকারি চাকরি, বিভিন্ন ক্রয়-বিক্রয় ও উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ শুরু করেন।
একবার তার সঙ্গে কেউ পরিচিত হলে তার প্রতারণার খপ্পর থেকে বের হতে পারে না। তিনি প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ২০১৯ সালে ফুলবাড়িয়া এলাকায় প্রায় এক বিঘা জমি কিনে প্যারিস সুইমিংপুল এন্টারটেইনমেন্ট পার্ক নামে রিসোর্টের কাজ শুরু করেন। সেখানে তার প্রলোভনে পড়ে অনেকেই টাকা লেনদেনের রসিদ ছাড়া লাখ লাখ টাকা লগ্নি করেন। ২০২০ সাল প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে রিসোর্টের কাজ শেষ হলে পরবর্তীতে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। রিসোর্টে প্রবেশ মূল্য ৫০ টাকা, সুইমিংপুলে গোসল ১০০ টাকা এবং রিসোর্টের ভেতরে ঘোরাঘুরির জন্য ৫০ টাকা করে টিকিট বিক্রি করা শুরু করেন।
অনেকে বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য তার রিসোর্ট ভাড়া নিতে থাকে।
একাধিক ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট রয়েছে উলেখ করে কমান্ডার মঈন বলেন, অ্যাকাউন্টগুলোতে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বর্ণ চোরাচালান বাণিজ্যের সঙ্গেও তিনি জড়িত আছেন।