ঢাকা: দেশের দক্ষিণাঞ্চল বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে খ্যাত হলেও পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে এর রাজনৈতিক অবস্থান। প্রায় প্রতিটি জেলায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর সাংগঠনিকভাবে অযোগ্য নেতাদের কারণে সাধারণ মানুষ এখন আর বিএনপির ওপর ভরসা রাখতে পারছে না। কেন্দ্রের যথাযথ তদারকির অভাবে অবস্থা আরো ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। এ রকমেরই একটি জেলা পিরোজপুর।
কর্মীদের মাঝে হতাশা আর ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন ও গ্রুপিং কোন্দলের শিকার পিরোজপুর জেলা বিএনপির অবস্থান এখন নড়বড়ে। আর এ কারণে বিএনপির রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন কর্মী-সমর্থক ও সাধারণ মানুষ। পিরোজপুর সদরে এখন আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে তারা জামায়াতের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে অনেকটাই। এই আসনে জামায়াতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন দলটির নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। তার অবর্তমানে জেলার হাল ধরার চেষ্টা চালাচ্ছেন বড় ছেলে শামীম সাঈদী। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে পিরোজপুর সদর আসনে তিনিই জোটের প্রার্থী হবেন।
জেলা বিএনপির একাধিক নেতাকর্মী ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, পিরোজপুর সদরে প্রায় ৩০ বছরের দলীয় কোন্দলের কারণে বিএনপি সব সংসদ নির্বাচনগুলোতে লক্ষণীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ৭৯ সাল থেকে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলায় ১৯ জন প্রার্থী বিএনপি টিকিট নিয়ে বিভিন্ন সময় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও বিজয়ী হন মাত্র চারজন। এ ক্ষেত্রে সংসদীয় নির্বাচনে বিএনপির স্কোর অত্যন্ত নগণ্য।
তারা বলেন, দেশের যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় পিরোজপুর জেলা বিএনপির অবস্থান খারাপ। সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও নেতাদের অসাংগঠনিক নেতৃত্বের কারণে এখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন লোকজন।
সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা বিএনপির কোনো তৎপরতাই ছিল না বিগত দিনে, এখনো নেই। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়িয়েছে জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী। তাদের এ তৎপরতার ফলও তারা পাচ্ছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাতেও জামায়াত সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেন। অন্যদিকে নিজ দলের নেতাদের বিশ্বসাঘাতকতার কারণে সদর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী নির্বাচনের আগেই হেরে যান।
এ বিষয়ে বিএনপির সমর্থক ও কর্মীরা জানান, উপজেলা নির্বাচনে পিরোজপুর সদরে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বাছাইয়ে যোগ্যতার প্রমাণ রাখেনি। কারণ হিসেবে তারা বলেন, এই এলাকায় আওয়ামী লীগের এমপি এ কে এম আওয়াল ও তার ছোট ভাই পৌরসভা চেয়ারম্যান এম এ মালেক যথেষ্ট প্রভাবশালী। তাদের মোকাবিলার জন্য বিএনপির একজন শক্ত প্রার্থী দেয়া দরকার ছিল। কিন্তু তারপরও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী এলিজা জামানের অবস্থান আওয়ামী লীগের তুলনায় ভালো ছিল। নির্বাচনের দিন কয়েকটা কেন্দ্র দখল হওয়ার অজুহাত তুলে প্রার্থীর অজ্ঞাতে জেলা বিএনপি নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়, যা বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা সন্দেহ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, জেলা বিএনপির এ ঘোষণার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির জেলা কমিটির মধ্যে অন্যতম কোন্দলপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত পিরোজপুর জেলা বিএনপি। ওয়ান ইলেভেনপরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালের ৯ জুন জেলা বিএনপির দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। অথচ কোন্দলের কারণে প্রায় চার বছর পর ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হলেও এ কমিটির অধিকাংশ নেতা এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন। এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। এমনকি অনেক কর্মী তাদেরকে চেনেও না। অপরদিকে এ কমিটি ঘোষণার পরও কোন্দল থামেনি। বরং দিন-দিন তা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।
নেতায়-নেতায় দ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ এক কর্মী বলেন, জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি এখন সৃষ্টিকর্তা চালাচ্ছেন। দলের নেতাদের মধ্যেই জিয়ার আদর্শ নেই। দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নেতাদের কাছে এখন আদর্শ হচ্ছে- কিভাবে হঠাৎ নেতা হওয়া যায়। আর তাহলেই আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মতো রাতারাতি সব পরিবর্তন করা সম্ভব।
অভিযোগ রয়েছে, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বর্জনের আন্দোলনে জেলা বিএনপির সদস্য ব্যারিস্টার সারোয়ারসহ হাতে গোনা দুই-একজন নেতা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের অখ্যাত কর্মী ও সমর্থকরা রাজপথে নামেন। যারা আহত হয়েছেন তাদের খোঁজ-খবরও নেন না জেলা বিএনপির নেতৃবৃন্দ। এমনকি তাদের পরিচয়ও জানেন না তারা।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য মাত্র ছয় হাজার ভোট পেয়ে পরাজিত হন। অথচ, ১৯৯১ সালে একই আসন থেকে তিনি ৩৮ হাজার ভোট পেয়েছিলেন। নির্বাচনে তার এ শোচনীয় পরাজয়ের পর নেতাকর্মীদের তোপের মুখে তিনি রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। দীর্ঘকাল সংগঠনিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে থাকা জেলা সভাপতি গাজী নুরুজ্জামান বাবুল ১২ বছর পর জেলার দলীয় রাজনীতিতে এসে নতুন প্রজন্মের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেননি। চোরাগুপ্তা পথে হাঁটতে গিয়ে সারা জেলায় বিএনপিকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেন তিনি। তাই জেলার সদর পৌর শাখাসহ বিভিন্ন ইউনিট কমিটিতে রয়েছে দুটি করে কমিটি।
সাংগঠনিক জেলার অধীন ১০টি সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। কোন্দলের কারণে এসব ইউনিটের অনেকগুলোই কমিটি গঠন করা হয়নি। আর যেগুলো আছে তাও মোয়াদহীন অকার্যকর অবস্থায়। এছাড়া অঙ্গ সংগঠনের অবস্থা আরো ভয়াবহ। ছাত্রদলের দীর্ঘদিনের আহ্বায়ক কমিটি ভেঙে দেয়া হয়েছে। এখন কমিটি ছাড়াই রয়েছে আন্দোলন সংগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এ সংগঠনটি। জেলা যুবদল দুই সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে, যার কার্যক্রম নেই। জোড়াতালি দিয়ে চলছে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কমিটি। মহিলা দলের আহ্বায়ক কমিটির অস্তিত্ব নিয়েই শঙ্কা প্রকাশ করেছেন নেতাকর্মীরা।
অন্যদিকে জেলার উপজেলা কমিটিগুলোর অবস্থাও ভালো না। প্রত্যেকটি উপজেলায় রয়েছে দুই তিনটি গ্রুপ। অনেক উপজেলা কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ। ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। মঠবাড়িয়া উপজেলায় নেতাকর্মীদের সংগঠিত, খোঁজ-খবর নেয়াসহ সব ধরনের সাংগঠনিক কাজ করছেন উপজেলা সেক্রেটারি রুহল আমিন দুলাল। কিন্তু ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েও পাননি। মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় বন-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কর্নেল শাহজাহান মিলন। এলাকাতে তার কোনো কার্যক্রম নেই। তিনি সবসময়ই ঢাকা থাকেন। আরেকজন রয়েছেন মৎসজীবী দলের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাহতাব। তিনিও ঢাকা থাকেন। তবে তার একটা গ্রুপ আছে।
এই তিনজন নিয়ে বিএনপির তিনটি গ্রুপ কাজ করছে। কারো সঙ্গে কোনো সমন্বয় নেই। এখানে একজন ইউপি চেয়ারম্যান আছেন। যিনি একটানা ২৫ বছরের বেশি সময় চেয়ারম্যান ছিলেন। ব্যাক্তি হিসেবে তার ইমেজ অনেক ভালো। তার এই ইমেজকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের লক্ষে কাজ করছে উপজেলা জামায়াত।
ভান্ডারিয়া-জিয়ানগর উপজেলায় বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থাও ভালো না। এখানে সাঈদীর ইমেজকে কাজে লাগিয়ে তার মেঝো ছেলে মাসুদ সাঈদীকে সামনে রেখে জামায়াতের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। পরবর্তী নির্বাচনে এই আসনে তাকে প্রার্থী করার চিন্তা করছে জামায়াত। তিনি এখন জিয়ানগর উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন নতুন বার্তাকে বলেন, “অঙ্গ সংগঠনগুলোর জন্য জেলা বিএনপির দায়ী নয়। এসব অঙ্গ সংগঠনের কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হয়।”
তিনি বলেন, “আমি নিয়মিত এলাকায় থেকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের সব নির্দেশনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করি।”
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম সাইদুল ইসলাম কিসমত জানান, দলীয় কোন্দলের কারণে কয়েক বছর আগে ছাত্রদলের এক কর্মসূচি পালনকালে দুই পক্ষের মধ্যে ঘটেছে সংঘর্ষের ঘটনা। এ সময় জেলা কৃষকদলের সভাপতি গাজী সালাউদ্দিনের মতো দলীয় নেতাকে দিতে হয়েছে প্রাণ। তারপরও পিরোজপুরে বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতা-কর্মীদের আশা ছিল একটি সাচ্চা সাংগঠনিক ভিত্তির। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।