মার্কিন ভিত্তিক অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান হিনডেনবার্গ রিসার্চ সম্প্রতি বিশ্বের তৃতীয় এবং ভারতের সর্বোচ্চ ধনী গৌতম আদানির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান আদানি গ্রুপের প্রতারণা ও দুর্নীতির ওপর এক তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দুই বছর ব্যয়ে তৈরি করা তদন্ত প্রতিবেদনে আদানি গ্রুপের ২১৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের জালিয়াতি ও শেয়ারবাজারে কারচুপিতে জড়িত থাকার বিশদ বিবরণ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। হিনডেনবার্গ বলছে, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের মুখোশ পরে ভারতকে লুট করে চলেছে আদানি গোষ্ঠী।
হিনডেনবার্গের দাবি, আদানি গ্রুপ তার নিট সম্পদ ১২০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন অর্জন করেছে শুধু গত তিন বছরে। আদানি গ্রুপের প্রাক্তন সিনিয়র এক্সিকিউটিভসহ কয়েক ডজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা, হাজার হাজার নথি পর্যালোচনা করা এবং প্রায় অর্ধ ডজন দেশে যথাযথ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার মাধ্যমে এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আদানি গ্রুপ এর আগে ৪টি বড় সরকারি জালিয়াতির তদন্তের কেন্দ্রবিন্দু ছিল যার মধ্যে মানি লন্ডারিং, করদাতার তহবিল চুরি এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে যার মোট পরিমাণ আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন ডলার। আদানি পরিবারের সদস্যরা মরিশাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মতো ট্যাক্স-হেভেন এখতিয়ারে অফশোর শেল সত্তা তৈরি করতে সহযোগিতা করেছিল, জাল বা অবৈধ টার্নওভার তৈরি করার এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলি থেকে অর্থ পাচারের জন্য জাল আমদানি/রপ্তানি ডকুমেন্টেশন তৈরি করে।
গৌতম আদানির ছোট ভাই রাজেশ আদানিকে ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্স (ডিআরআই) দ্বারা ২০০৪-০৫ সালের দিকে হীরা ব্যবসার আমদানি/রপ্তানি প্রকল্পে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল। রাজেশকে জালিয়াতি এবং কর জালিয়াতির পৃথক অভিযোগে কমপক্ষে দুবার গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি আদানি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।
গৌতম আদানির শ্যালক সমীর ভোরার বিরুদ্ধে ডিআরআই একই হীরা ব্যবসার কেলেঙ্কারির একজন প্রধান নেতা এবং নিয়ন্ত্রকদের কাছে বারবার মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ার জন্য অভিযোগ আনা হয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি সমালোচনামূলক আদানি অস্ট্রেলিয়া বিভাগের নির্বাহী পরিচালক পদে উন্নীত হন।
গৌতম আদানির বড় ভাই বিনোদ আদানিকে মিডিয়াতে ‘একজন অধরা ব্যক্তি’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। জালিয়াতির সুবিধার্থে ব্যবহৃত অফশোর সত্ত্বাগুলির নেটওয়ার্ক পরিচালনায় তার অভিযুক্ত ভূমিকার জন্য তাকে নিয়মিত আদানিতে সরকারের তদন্তের কেন্দ্রে পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আমরা বিনোদ আদানি বা ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের নিয়ন্ত্রিত ৩৮টি মরিশাস শেল সত্তা চিহ্নিত করেছি। আমরা সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এবং বেশ কয়েকটি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে গোপনীয়ভাবে বিনোদ আদানির নিয়ন্ত্রিত সত্তাকে চিহ্নিত করেছি।
কিন্তু বিনোদ আদানির সঙ্গে জড়িত অনেক সংস্থারই কার্যক্রমের কোনো লক্ষণ নেই এমনকি নেই কোনো কর্মচারী, কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর। শুধু তাই নয়, অনলাইনেও তাদের কোনো উপস্থিতি মেলেনি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কিন্তু অস্তিত্বহীন ব্যবসার নামে এসব সর্বজনীনভাবে তালিকাভুক্ত এবং ব্যক্তিগত সংস্থাগুলিতে বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে ভারতীয় আদানি গ্রুপ।
গৌতম আদানি একটি সাক্ষাত্কারে দাবি করেছিলেন, ‘সমালোচনার প্রতি মন খুব খোলা আছে… প্রতিটি সমালোচনা আমাকে নিজেকে উন্নত করার সুযোগ দেয়।’ এই দাবিগুলি সত্ত্বেও, আদানি বারবার সমালোচনামূলক সাংবাদিক বা ভাষ্যকারদের কারাগারে বা নীরব করার চেষ্টা করেছেন মামলার মাধ্যমে, সরকার ও নিয়ন্ত্রকদের চাপ দেওয়ার জন্য তার বিপুল ক্ষমতা ব্যবহার।
হিনডেনবার্গ তাদের এই অনুসন্ধানের সত্যতা প্রমাণ করতে আদানি গ্রুপকে ৮৮টি নির্দিষ্ট প্রশ্ন করে বলে জানিয়েছে। কিন্তু আদানি গ্রুপ এর মধ্যে ৬২টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেনি। দীর্ঘ জবাবদিহির মধ্যে মাত্র ৩০ পৃষ্ঠায় তারা মূল বিষয়গুলোর অবতারণা করেছে। বাকি পৃষ্ঠায় রয়েছে অবান্তর সব বিষয়ের উল্লেখ। যেমন কীভাবে তারা নারীদের উদ্যোগী হতে সাহায্য করছে কিংবা কীভাবে নিরাপদ সবজি উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু হিনডেনবার্গের এই প্রতিবেদনকে ভারতের ওপর আক্রমণের সঙ্গে তুলনা করেছে আদানি গ্রুপ।
প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় আদানি বলেছে, ‘এটি নিছক কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির আক্রমণ নয় বরং ভারতের ওপর আক্রমণ, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা এবং গুণমান এবং ভারতের বৃদ্ধির গল্প এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি আক্রমণ। অভিযোগ এবং অনুমান, যা সত্য হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছিল, তা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে, বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগকারীর সম্পদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়। নিট ফলাফল হল যে পাবলিক বিনিয়োগকারীরা হেরে যায়।
এদিকে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পরপরই পতন হতে শুরু করে শেয়ার। এরই মধ্যে গত তিন দিনে সাত হাজার কোটি ডলার হারিয়েছে আদানি গ্রুপ। এর ফলে আদানির ব্যক্তিগত সম্পদেও ধস নেমেছে। ভারতীয় এ ধনকুবের বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনীদের তালিকায় তৃতীয় অবস্থান থেকে নেমে গেছেন আট নম্বরে। আদানি গোষ্ঠীতে লগ্নিকারী রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভারতীয় জীবনবিমা করপোরেশন (এলআইসি) ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার বিপুল লোকসান হয়।
হিনডেনবার্গের রিপোর্টে আদানি সাম্রাজ্যকে ‘করপোরেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কারসাজি’ এবং ‘নির্লজ্জ শেয়ারবাজার কারসাজি এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতি প্রকল্পে’ জড়িত বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
হিনডেনবার্গ রিসার্চের গবেষণায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ গুজরাটি শিল্পগোষ্ঠী আদানিদের অস্বাভাবিক বাণিজ্যিক উত্থানের পেছনে জালিয়াতি ও শেয়ারবাজারে কারচুপিকে বড় করে দেখানো হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত রবিবার ৪১৩ পৃষ্ঠার এক জবাবি বয়ান তৈরি করে হিনডেনবার্গের কাছে পাঠায় আদানি গ্রুপ। জবাবি বয়ানে ভারতের আইনি ব্যবস্থা সম্পর্কে হিনডেনবার্গের স্পষ্ট ধারণা নেই বলে জানিয়েছে তারা। এছাড়াও বাজারে পুঁজি সংগ্রহ কীভাবে করা হয়, সে বিষয়েও তাদের ধারণা কম, তাই তারা ভিত্তিহীন অভিযোগ খাড়া করেছে বলে দাবি আদানি গ্রুপের।
আদানি গোষ্ঠী ওই প্রতিবেদনকে ‘মিথ্যাচার’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, অশুভ মনোভাব নিয়ে ভ্রান্ত তথ্যের ওপর নির্ভর করে তৈরি এই প্রতিবেদন দুরভিসন্ধিমূলক। তাদের জবাব প্রত্যাখ্যান করে আজ সোমবারই পাল্টা উত্তর দেয় হিনডেনবার্গ। তারা বলে, ‘মূল বিষয়গুলো থেকে নজর ঘোরাতেই জাতীয়তাবাদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে আদানি গ্রুপ। নিজের ও সংস্থার মাত্রাছাড়া শ্রীবৃদ্ধিকে দেশের উত্থানের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা একমত নই। জালিয়াতি মানে জালিয়াতিই।’
ভারতকে ছোট করার অভিযোগের জবাবে হিনডেনবার্গ বলেছে, তাদের অভিযোগ নির্দিষ্ট এক সংস্থার বিরুদ্ধে। ভারতের বিরুদ্ধে নয়। ভারতের গণতন্ত্র প্রাণবন্ত। ভারত শিগগিরই বিশ্বের শক্তিশালী দেশের তালিকায় ঢুকতে চলেছে। আমরা বিশ্বাস করি, ভারতের ভবিষ্যতে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আদানি গোষ্ঠী। ভারতীয় পতাকায় শরীর ঢেকে তারা দেশকে লুট করে চলেছে।’
ঢাকাটাইমস