তড়িঘড়ি করে বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে গত আগস্টে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। আর গত জুনে বেড়েছে গ্যাসের দাম। বাকি আছে পানির দাম, তা–ও বাড়ানোরও উদ্যোগ আছে।
এখানেই শেষ নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন যে মাসে মাসে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। একইভাবে আবারও সমন্বয় করা হবে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দামও। কারণ, সরকারকে এসব খাতে ভর্তুকি কমাতে হবে। এটাই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অন্যতম শর্ত।
আইএমএফের ঋণের চূড়ান্ত অনুমোদনের আগেই সরকার কিছু শর্ত পূরণ করা শুরু করে দিয়েছে। মূলত যেসব শর্ত পূরণ করা সহজ, যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বাড়ায়, সেগুলোই সরকার দ্রুত করছে। কিন্তু অতীতেও দেখা গেছে যেসব সংস্কার অজনপ্রিয়, যার কারণে প্রভাবশালীরা চাপে পড়বে, তাদের সুযোগ-সুবিধা কমবে, সেসব শর্ত শেষ পর্যন্ত খুব একটা বাস্তবায়িত হয় না।
আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের কারণে দেশে দেশে সামাজিক অসন্তোষ দেখা দেওয়ার ঘটনাও একাধিক। দক্ষিণ আমেরিকার ভেনেজুয়েলা, আফ্রিকার মিসর, মরক্কো, নাইজেরিয়া এবং এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার সাধারণ মানুষকে এ জন্য রাস্তায়ও নামতে হয়েছিল। পাকিস্তানও শর্ত পূরণ করতে পারছে না বলে ঋণ আটকে আছে। যদিও দেশটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে, এমন কিছু তারা করতে চায় না।
মূলত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ। আইএমএফও প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছে। চলতি মাসের শেষে আইএমএফ বোর্ড বাংলাদেশের ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করবে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুতেই ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে। চূড়ান্ত আলোচনার জন্য আইএমএফের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) অ্যান্তইনেত মনসিও সায়েহ গতকাল শনিবার ঢাকায় এসেছেন।
আগে কী অভিজ্ঞতা
আইএমএফের কাছ থেকে সর্বশেষ বাংলাদেশ ঋণসহায়তা পেয়েছিল ২০১২ সালে। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০ সালেই আইএমএফ থেকে ঋণ চাওয়ার কথা প্রথম বলেছিলেন। পরের বছর সেপ্টেম্বরে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে ঋণসহায়তা চান তিনি। এরপর ২০১২ সালের ২৭ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আইএমএফকে চিঠি লেখা হয়। পরের মাসে, ১১ এপ্রিল আইএমএফ বোর্ড ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং পরের মাসেই ঋণের প্রথম কিস্তি পায়। বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) নামের সেই কর্মসূচি চলে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত।
সেই ঋণ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু থেকে ঋণের শেষ কিস্তি পাওয়া পর্যন্ত সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল পাঁচবার, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় আটবার এবং পানির দাম বাড়ানো হয় পাঁচবার। তবে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভর্তুকি কমানোর শর্ত মেনে সরকার এসব সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করলেও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের কারণে বেশ কিছু সংস্কার সরকার করতে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল নতুন ভ্যাট আইন। ব্যবসায়ীদের চাপের মুখে ভোটের আগে ভ্যাট আইন করবে না বলে সরকার জানিয়ে দিলে আইএমএফ ঋণের কিস্তি এক বছর আটকে রেখেছিল। ২০১৬ থেকে নতুন আইন বাস্তবায়ন করা হবে, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরই আইএমএফ ২০১৫ সালের নভেম্বরে শেষ দুই কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করেছিল। এমনকি সরকার তখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের সংস্কারও পুরোপুরি করেনি।
২০২৪ সালের শুরুতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সুতরাং এখন সরকার নির্বাহী আদেশে সরকারি নানা পরিষেবার দাম বাড়ালেও নির্বাচনের ঠিক আগে আর্থিক ও রাজস্ব খাতের সংস্কার কতটা করতে পারবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
বাংলাদেশ এর আগে ১২ বার আইএমএফের ঋণ পেয়েছে। ১৯৭২ সালে সদস্য হওয়ার পর আইএমএফ থেকে প্রথম ঋণ নেওয়া হয় ১৯৭৪ সালে। ২০১২ সালে নেওয়া সর্বশেষ ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। সেটাই ছিল আইএমএফের কাছ থেকে নেওয়া সর্বোচ্চ ঋণ। আর এবার বাংলাদেশ পাবে আরও বেশি—৪৫০ কোটি ডলার। এই অর্থের মধ্যে ৩২০ কোটি ডলার পাওয়া যাবে বর্ধিত ঋণ সুবিধার (ইসিএফ-ইএফএফ) আওতায় এবং বাকি ১৩০ কোটি দেওয়া হবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলায়।
মোটাদাগে আইএমএফের ঋণ শর্তের ধরন প্রায় একই রকম। দেশে দেশে পার্থক্য থাকে না। তবে তারা সব ঋণ একসঙ্গে ছাড় করে না। সাত কিস্তিতে তা দেওয়া হয় এবং প্রতি কিস্তি দেওয়ার আগে আইএমএফ শর্ত বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করে। বাংলাদেশ প্রথম কিস্তিতে পাবে ৪৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। এর পর থেকে ৬৫ কোটি ৯১ লাখ ৮০ হাজার ডলার করে ৬ কিস্তিতে বাকি অর্থ দেওয়া হবে। সুতরাং শর্ত পূরণ না করলে কিস্তি আটকে যাবে।
কবে কোন শর্ত পূরণ করতে হবে, তা আইএমএফ প্রকাশ করবে বোর্ডের অনুমোদনের পর। তবে আলোচনা পর্যায়ে এ নিয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বেশ কিছু আলোচনা হয়েছে। তখনো বেশ কিছু সংস্কার করণীয় নিয়ে বাংলাদেশ সম্মতি দিয়েছে। মূলত পাঁচ ধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশকে করতে হবে। যেমন সরকারের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতির কাঠামো আধুনিক করা, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বাণিজ্য পরিবেশ ভালো করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবিলার সামর্থ্য বাড়ানো। এই পাঁচ ধরনের বিষয়ের মধ্যে মূল বিষয়গুলো হচ্ছে, সরকারের ভর্তুকি কমাতে হবে, যাতে সরকার বেশি অর্থ উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে ব্যয় করতে পারে। এ জন্য সরকারকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, গ্যাস, পানি ও সারের দাম বাড়াতে হবে। এই পাঁচ পণ্যেই সরকারকে বেশি ভর্তুকি দিতে হয়। সরকার এ কাজ সহজেই করে ফেলছে। রাজস্ব আয় বাড়ানোর শর্তও এবার রয়েছে। এ জন্য নানা খাতে যেসব করছাড় দেওয়া হয়, তা কমাতে বলেছে আইএমএফ। নির্বাচনের আগে সরকার তা কতটা করবে, সেটাও বড় প্রশ্ন।
মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ মুদ্রানীতিকে তেমন ব্যবহার করছে না। মুদ্রানীতিকে আধুনিক করতে প্রথম বাংলাদেশ ব্যাংককে সুদহার নীতি নমনীয় ও বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে হবে। নব্বইয়ের দশকে আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতাতেই বাংলাদেশ প্রথম সুদহার বাজারব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। সেই সুদহার এই সরকার আবার ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আইএমএফ এই নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে বলেছে। ব্যবসায়ীদের খুশি রাখার এই পথ থেকে নির্বাচনের আগে সরকার সরে আসতে পারবে কি না, সেটাও এখন দেখার বিষয়। আইএমএফ বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত মজুত বা রিজার্ভ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। সরকারের হিসাবে এখন রিজার্ভ হচ্ছে ৩ হাজার ২৫২ কোটি ডলার। কিন্তু এই অর্থের মধ্যে ৮১০ কোটি ডলার বাংলাদেশ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ দিয়েছে, যা চাইলেই সরকার ব্যয় করতে পারবে না। এই অর্থ হিসাব থেকে বাদ দিতে বলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা মেনেও নিয়েছে।
দেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে এখন ব্যাংক খাত। আইএমএফ খেলাপি ঋণ কমানো, সরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে আমলা পরিচালকদের বাদ দেওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা বাড়ানো, বেসরকারি ব্যাংক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং পুঁজিবাজারকে উন্নত করার কথা বলেছে। সরকারের জন্য এটিই হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা এই খাত দখল করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরও পৃষ্ঠপোষকতা আছে।
এশিয়ায় বাংলাদেশই প্রথম
রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফান্ড (আরএসএফ) নামের একটি নতুন তহবিল আইএমএফ গঠন করেছে গত বছরের ১৩ এপ্রিল। যেসব স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিতে আছে, তারা এই তহবিল থেকে ঋণ পাবে। ইতিমধ্যে বারবাডোজ, কোস্টারিকা ও রুয়ান্ডা এই ঋণ পেয়েছে। এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই ঋণ পেতে যাচ্ছে। ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১৩০ কোটি ডলার এই ঋণ। এই ঋণ পরিশোধের সময় ২০ বছর, আর এর বাড়তি সময় বা গ্রেস পিরিয়ড হচ্ছে সাড়ে ১০ বছর।
কোথায় ব্যবহৃত হবে অর্থ
৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ৩২০ কোটি ডলার বাংলাদেশ বাজেট সহায়তা হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। বাকি ১৩০ কোটি ডলার খরচ করতে হবে দীর্ঘ মেয়াদে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করার মতো কর্মসূচিতে। সুতরাং আগামী বাজেটে অর্থ ব্যয়ের জন্য সরকারের হাতে বাড়তি অর্থ থাকবে। আইএমএফ ছাড়াও বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও বাজেট সহায়তার অর্থ চেয়েছে সরকার। এখন এই অর্থ নির্বাচন সামনে রেখে নানা ধরনের ভোটের ও জনতুষ্টির প্রকল্পে সরকার ব্যয় করবে, নাকি অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক কর্মসূচি নেওয়া হবে, সেটাই প্রশ্ন। এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকায় রাস্তা প্রশস্ত করা, হাওরে উড়ালসেতু নির্মাণ বা নির্বাচনের জন্য ইভিএম প্রকল্প নিয়ে কথা উঠেছে। সামনে আরও ভোটের প্রকল্প আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সহজ শর্ত বাস্তবায়ন করছে সরকার। কিন্তু রাজস্ব বৃদ্ধি, ব্যাংক খাতে সুশাসন আনা বা খেলাপি ঋণ কমানোর মতো কঠিন বিষয়গুলো সরকার আসলে কতটুকু করতে পারবে। এর জবাবে আহসান মনসুর প্রথম আলোকে, যেহেতু ৪২ মাসের ঋণ কর্মসূচি, ফলে ব্যাংক ও রাজস্ব খাতের কাঠামোগত সংস্কারের কাজে হাত দেওয়াই উচিত সরকারের। ফাঁকি দিতে চাইলে সরকার দিতেই পারবে। এতে আইএমএফের কিছু যাবে-আসবে না। ছাত্র যদি শিক্ষককে ফাঁকি দেয়, তাতে শিক্ষকের কিছু যায়–আসে?