সেদিন এক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছি। পাশের টেবিলে বেশ উচ্চ স্বরে দুই বন্ধু গল্প করছিলেন। এতটাই উচ্চ স্বরে যে আড়ি পাতার প্রয়োজন পড়ে না, অন্যের কান অবধি আপনা-আপনি এসে পড়ে। তাঁদের একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, ‘ভাবি এখন কিছু করছে?’ উত্তরে আরেক বন্ধু বললেন, ‘আরে, আমার বউ যে কত কাজ নিয়ে ব্যস্ত, সে কথা আর বলিস না। বাড়িতে বেকিং করছে, অনলাইনে সেসব বিক্রি করছে। তাঁর গ্রাহকেরা বাসায় আসছে। অর্ডার দিচ্ছে। বেকিংয়ের ফাঁকে অনলাইনে পোশাক-গয়নাও বিক্রি করে। এগুলো সংগ্রহ করতে এখানে-সেখানে খুব ছোটাছুটি করতে হয় ওকে। দম নেওয়ার সময় নেই বেচারার।’ স্বামী যে বউয়ের কাজে খুশি, তা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না।
একটা সময়ে দেখা যেত, বিয়ের পর স্ত্রী কাজ করবে কি করবে না, এটা একটা বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াত। এখনো অনেক ক্ষেত্রে এমন হয়। স্ত্রী বড় কোনো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, উচ্চ পদে আছেন, বাড়িতে অনলাইন ব্যবসা, ক্ষুদ্র উদ্যোগ বা সামাজিক কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন—ইদানীং এটা অনেক স্বামীকে খুশি মনে বলতে শোনা যায়। স্বামীর সামাজিক মর্যাদাকে আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। স্বামী গর্ব করেই বলেন, ‘আমার বউ “কিছু” করছে।’
বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি সেলিমা আহমাদ মনে করেন, পদক্ষেপ ছোট হলেও এটি ইতিবাচক। স্বামীদের এই চাওয়াকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বিষয়টি যেন এমন না হয়, স্বামীর ইচ্ছা পূরণ করতেই তিনি কাজ করছেন। নিজের ভালো লাগার জন্য, অর্জনের জন্য কাজ করতে হবে। তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে না।
স্ত্রীর কাজকে সমর্থন জানালে, সহযোগিতা করলে ভালো। কিন্তু বিষয়টি যেন এমন হয়ে না দাঁড়ায় যে স্বামী স্ত্রীর কাজে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। অনেক সময় দুজনের আলোচনা থেকে ভালো কিছু হয়। সেটি যেমন ঠিক, আবার স্ত্রীর মতামতের গুরুত্ব থাকছে কি না, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।
অনলাইন সংবাদ মাধ্যম হাফিংটন পোস্টে মার্টিন হামের এক লেখক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, তাঁর স্ত্রী উচ্চশিক্ষিত। সন্তানদের জন্য চাকরি করতে পারছিলেন না। এটি নিয়ে তিনি মনে মনে সব সময় বিরক্ত হয়ে থাকতেন। ঝগড়া, সংসারে অশান্তি লেগেই থাকত। কিন্তু স্ত্রী ঘরে বসেই যখন আয় করতে শুরু করলেন, সেই গুমোট পরিবেশ কেটে গেল। তাঁর স্ত্রী অনেক খুশি এখন। স্ত্রীর খুশিতে স্বামী মার্টিনও খুশি। ভাগ্যিস, বউয়ের খুশিতে আমিও খুশি। তা না হলে এ বছর দুটি উপন্যাস লেখা শেষ করতে পারতাম না। যেহেতু স্ত্রী আয় করছে, ফলে আর্থিকভাবেও নিরাপদবোধ করছেন। সংসারে দুজনই কাজে ব্যস্ত থাকলে একটা ‘স্পেস’ বা জায়গা পান স্বামী-স্ত্রী দুজনই। দাম্পত্য জীবনে শান্তির জন্য এমন ‘স্পেস’ দরকার।
অনেক সময় বাড়ির বউকে মূল্যায়ন করেন না শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা। কিন্তু মেয়েকে তাঁরা চাকরি বা কাজ করতে উৎসাহিত করেন। বাড়ির মেয়ে ও বউকে একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) সাবেক সভাপতি পারভীন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নারীর চাকরি, ব্যবসা বা সামাজিক যেকোনো কাজ শুধু স্বামী নন, সন্তানদেরও সম্মান বাড়ায়। তারাও বলতে ভালোবাসেন, তাঁদের মা কিছু করেন। এখন তো ঘরের কাজকেও স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আর স্ত্রীকে স্বামী যে তাঁর কাজের জন্য মূল্যায়ন করছেন, আমি মনে করি এটা ইতিবাচক। নারীদেরও মনে রাখতে হবে, তাঁর কাজ যেন তাঁর সক্ষমতা, অর্জন প্রকাশ করে। সময় ব্যবস্থাপনা মেনে চললে ঘরে-বাইরে সব কাজই করা সম্ভব। নারীর কাজ তাঁর আত্মবিশ্বাসও বাড়ায়।
গৃহস্থালি থেকে শুরু করে যেকোনো আর্থিক কাজে নারী যত যুক্ত থাকবেন, তত সব পক্ষের জন্য ভালো। বিশেষ করে আমাদের অর্থনীতির জন্য। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নগরায়ণ, সংস্কৃতি—সবকিছু মিলিয়ে নারীর কাজে যুক্ততা তাকে পরিবারে, সমাজে আরও যোগ্য করে তুলছে। পরিবার, স্বামীর কাছে তা মর্যাদাকর। শুধু তা-ই নয়, শিশুর মনোবিকাশে এটি প্রয়োজন।
নারীরা যত বেশি কাজে সঙ্গে যুক্ত হবে, তত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে। একই গতিতে স্বীকৃতিও মিলবে।
সূত্র :প্রথম আলো