আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী ববিতা। ষাটের দশকের শেষ দিকে জহির রায়হানের জ্বলতে সুরুজ কি নিচে ছবির মাধ্যমে তাঁর অভিনয় শুরু। শেষ পর্যন্ত ছবিটির কাজ শেষ করতে পারেননি জহির রায়হান। এরপর নুরুল হক বাচ্চু পরিচালিত শেষ পর্যন্ত ছবিতে ফারুকের বিপরীতে অভিনয় করেন, যা ছিল নায়ক ফারুকের প্রথম অভিনীত ছবি। এই ছবিটিও শেষ পর্যন্ত মুক্তি পায়নি। টানা দুটি ছবি মুক্তি না পেলেও অবশেষে জহির রায়হানের সংসার ছবির মাধ্যমে তাঁর পর্দা অভিষেক হয়। এই ছবিতে তিনি নায়ক রাজ্জাক ও নায়িকা সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। এরপর কেটে যায় অনেক বছর। অভিনয় করে গেছেন প্রায় তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে। সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত (১৯৭৩) ছবিতে অভিনয় করে অর্জন করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। এই ছবির অনঙ্গ বউ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কার পান ববিতা। ক্যারিয়ারে পরপর তিনবারসহ পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। ঝুলিতে আছে আরও অসংখ্য পুরস্কার। বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও অংশগ্রহণ করেছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি চলচ্চিত্র প্রযোজনাও করেছেন ববিতা। তাঁর প্রযোজিত চলচ্চিত্র পোকামাকড়ের ঘরবসতি ঘরে তুলে নেয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অভিনয়ের কল্যাণে একটা সময় তিনি ডিসট্র্যাস চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের গুডউইল অ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব পান। নারী দিবসে কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই অভিনেত্রী। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনজুর কাদের।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারী দিবসে আপনার প্রত্যাশা কী?
আমি চাই, নারীরা যেভাবে এগিয়েছে, সামনেও তাঁদের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক। যখন দেখি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, বিরোধীদলীয় নেতা নারী, বৈমানিক নারী, পুলিশের উচ্চপদস্থ পদেও নারী, তখন খুব ভালো লাগে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নারীদের সদর্প বিচরণ দেখে খুশিতে মনটা ভরে যায়। বুকটা অনেক বড় হয়ে যায়। আগে যেমন নারীদের শুধুই ঘরে বন্দী থাকতে হতো, এখন কিন্তু তেমনটা নেই। আমাকে দিয়ে এর বিচার করতে পারি। আমার মা ছিলেন খুবই সংস্কৃতিমনা। তিনি আমাদের বলতেন, শুধু পড়ালেখা দিয়ে চলবে না। কবিতা আবৃত্তি, নাচ-গান, অভিনয় সব জায়গায় সমানভাবে পরদর্শী হতে হবে। আমরা যখন চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছিলাম তখন বাবার পরিবারের অনেকে খুবই রক্ষণশীল আচরণ করতেন। শোবিজে কাজ করার ব্যাপারটি তাঁরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেন না। সবার ভাবখানা এমন যে চলচ্চিত্রে গেছে মানে সবকিছুর বারোটা বেজে যাবে। তারপর তাঁদের সঙ্গে অনেক দিন তো আমাদের কথা বলাই বন্ধ ছিল। কিন্তু একটা সময় যখন বেশ সুনাম পেতে শুরু করলাম, দেশে-বিদেশে সব জায়গায় লেখালেখি শুরু হলো, তখন আবার তাঁরাই খুব গর্ব নিয়ে আমাদের কথা বলা শুরু করলেন।
চাওয়ার সঙ্গে বাস্তবতার মিল কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
সামনে নারীদের আরও অনেক সুযোগ-সুবিধা তৈরি হবে। কাজেরও অনেক ক্ষেত্র তৈরি হবে। একটা সময় আমাদের ধারণা ছিল, নারীদের শুধু রান্নাঘর সামাল দিতে হবে। এখন তা থেকে তো আমরা অনেকটাই বেরিয়ে এসেছি। এটাই বা কম কিসে? আমি চলচ্চিত্রে থেকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলাম। যেমন চাইল্ড লিউকোমিয়া, অ্যাসিড সারভাইভারস ইত্যাদি। সবশেষে ডিসট্র্যাস চিলড্রেন অ্যান্ড ইনফ্যান্টস ইন্টারন্যাশনালের গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্ব পাই। সংগঠনটি যে ববিতাকে খুঁজে বের করে তাঁকে দিয়ে সমস্যাগুলো সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, তা অনেক বড় পাওয়া।
জীবনসংগ্রামে নারী হিসেবে আলাদাভাবে বাধার মুখোমুখি হয়েছেন কী?
বাধা তো ছিলই। ওই যে বললাম, মা ছাড়া কেউই আমার কাজকে সমর্থন করেনি। পারিপার্শ্বিক আরও অনেক অসুবিধাও ছিল। সবকিছু পাশ কাটিয়ে আমি আপন মনে চলেছি। কে কি বলল, তা নিয়ে আমি কখনোই মাথা ঘামাতে রাজি ছিলাম না।
বর্তমানে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি নারীর স্বাধীন বিকাশের জন্য অনুকূল বলে মনে করেন কি না, না হলে কোন বিষয়গুলোকে বাধা হিসেবে মনে করেন?
সমস্যা সারা জীবন থাকবে। বাধা আছে। বিশেষ করে মেয়েরা যখন শ্বশুরবাড়িতে যায় তখন সবচেয়ে বেশি বাধা পায়। তার হয়তো সৃজনশীল মেধা আছে, কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে সেটা কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারে না। ক্ষেত্রবিশেষে স্বামীদের কাছ থেকেও মেয়েরা অসহযোগিতা পায়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের নারীরা এখনো অনেকটাই চাপা স্বভাবের রয়ে গেছে।
সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও গণমাধ্যমে নারীর উপস্থিতিকে কীভাবে দেখেন? যে উপস্থিতি দেখা যায় তাতে নারীদের জীবনসংগ্রামের প্রতিফলন কতটুকু?
যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা যেমন সবাই আশা করে, কিন্তু সবকিছু অতিমাত্রায় ভালো না। যেমন গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অঙ্গনে পোশাক-আশাকের ব্যাপারে আমাদের একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, আমরা বাঙালি। সবকিছুর মধ্যে শালীনতা বজায় রেখে সুন্দরভাবে এগোনো যায়। আধুনিকতার নামে উগ্রতা কিন্তু খুব একটা ভালো না। এই বিষয়টার দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে বৈকি। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত উপলব্ধি। মেয়েরা নিজেদের উদ্যোগেও অনেক কিছু করার চেষ্টা করছে। অতিরঞ্জিত কোনো কিছুই ভালো না।
অনুপ্রাণিত হয়েছেন এমন নারীদের কথা জানতে চাই?
মাকে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা মনে করি। তিনি গ্রামের মহিলা হলেও বেশ আধুনিক ছিলেন। ওই সময়ে আমার মা জাহানারা বেগম কলকাতার লেডি ব্রেবর্ন কলেজে পড়াশোনা করেছেন। আমার মায়ের পড়াশোনার সময়ই ছোট বোন মারা যায়। তার পরও মা কিছুতেই হার মানেননি। পড়াশোনাও ঠিক রেখেছেন, সংসারও সামলেছেন। মুসলিম পরিবারে সংসার সামলে পড়াশোনা করার ব্যাপারটা ছিল অবিশ্বাস্য। আমার মা তখন বিভিন্ন সেমিনারে বক্তব্য দিতেন। নিজে সাইকেল চালাতেন। চিকিৎসক হয়ে আশপাশের সবাইকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। মায়ের এই ব্যাপারগুলো আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করত। মা আমার প্রথম ও প্রধান অনুপ্রেরণা। মা বলতেন, শুধু পড়ালেখা করলে হবে না। গান-বাজনা, নাচ-গান, কবিতা আবৃত্তি সবকিছু আমাকে শিখতে হবে।
কর্মজীবী নারীকে ঘর-বাইর সামলাতে হয়। সমন্বয়ের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
আমার স্বামী যখন মারা গেছেন, তখন আমার ছেলের বয়স মাত্র তিন বছর। মাঝেমধ্যে ভাবতাম একা কীভাবে সন্তান মানুষ করব। আমি হয়তো আবার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম। কিন্তু আমার তখন মনে হয়েছে, সেটা ভুল সিদ্ধান্ত হবে। আবার বিয়ে করলে আমি জানি না, আমার ছেলে আমাকে কিংবা নতুন মানুষটিকে কীভাবে গ্রহণ করত। এটাও ভেবেছি, নতুন মানুষটি আমার ছেলেকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারত কি না? এসব কিছু ভেবে আবার বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিই। আমার ছেলে এখন বিদেশে মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। কানাডার ওয়াটারলু ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক শেষে এখন মাস্টার্স করছে। তার রেজাল্টও অনেক ভালো। একা হয়েও যতটুকু মায়ের ভূমিকা পালন করা সম্ভব, তা করেছি। এমনকি বাবার দায়িত্বও আমাকে পালন করতে হয়েছে। পাশাপাশি নিজের কাজের ক্ষেত্রটাও ঠিক রেখেছি আমি। এ ছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডেও যতটুকু সম্ভব জড়িত থাকার চেষ্টা করেছি।
নতুন প্রজন্মের নারীদের কীভাবে দেখতে চান? তাদের জন্য কোনো পরামর্শ আছে কী?
নতুনদের প্রতি পরামর্শ হলো, কারও জন্য কিছু থেমে থাকে না। যদি ইচ্ছে থাকে সবকিছু ভালোভাবে করার, তবে তা অবশ্যই করা সম্ভব। আমি তো মনে করি, মোটামুটি হলেও আমি পেরেছি। অন্য মেয়েদের আমি বলব, তোমরাও আমার মতো সাহস করে এগিয়ে যাও। তাহলে তোমরাও অনেক কিছু করতে পারবে। নতুন প্রজন্মের নারীদের নিয়ে আমার অনেক প্রত্যাশা। তারা অনেক কিছু করবে। তারা সুন্দরভাবে দেশকে এগিয়ে নেবে। আমরা নারীরা অনেক দূর এগিয়েছি। সামনে আমরা আরও অনেক কিছু করতে পারব। আমি ঘরে বসে থাকব, আর স্বামী আয়-রোজগার করবে এবং সেই টাকায় আমি চলব কেন? কেন দুজন মিলে আয় করব না? দুজন মিলে সংসার এগিয়ে নিলে তা অনেক বেশি ভালো হয়। এখন কিন্তু দুজন মিলে আয়ের বিষয়টি হচ্ছে। সামনে আরও হবে।
প্রথম আলো