মারুফ খান : সাধারণত মানুষের মতো তারকাদেরও থাকে নানা রকম মানসিক সমস্যা। বলতে গেলে মানসিক সমস্যার প্রভাব তারকাদের জীবনে একটু বেশিই লক্ষ্য করা যায়। অনেক খ্যাতিমান তারকা তো মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে বেছে নিয়েছেন মৃত্যুর পথ।
শারীরিক অসুস্থতা বা সমস্যা নিয়ে আমরা যতটা খোলাখুলিভাবে কথা বলতে পারি, মানসিক অসুস্থতা বা সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ঠিক ততটাই পিছিয়ে যাই। অথচ অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক সমস্যা ডেকে আনতে পারে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা।
কিন্তু এমন অনেক তারকা রয়েছেন যারা মানসিক সমস্যাকে মোকাবিলা করে জীবনে হয়েছেন সফল। এমন কয়েকজন তারকাকে নিয়ে আমাদের আজকের রচনা।
মেরিলিন মনরো : শৈশব থেকেই অবহেলায় কেটেছে মেরিলিন মনরোর জীবন। মানসিকভাবে অসুস্থ এক বিধবা মায়ের সন্তান মেরিলিন। এদিকে মাত্র ৬ বছর বয়সে পড়েছিলেন যৌননির্যাতনের কবলে। তবে সে যাত্রায় বেঁচেছিলেন। বুদ্ধি ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে আগ্রহের জেরে অন্যতম সেরা তারকা হয়ে ওঠেন মেরিলিন।
তবে খ্যাতির চূড়ায় থাকার সময়ই ঘুমের ওষুধ ও অ্যালকোহলে ডুবে থাকতে শুরু করেছিলেন মেরিলিন। গর্ভপাত, বিবাহ বিচ্ছেদ, বন্ধুর মৃত্যু, অস্থির সম্পর্কের জেরে ক্রমশ অবসাদের গভীরে তলিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন মানসিক সমস্যা মোকাবিলা করে ক্যারিয়ারে সফল হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মেনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন এ তারকা।
মাইকেল ফেল্পস : অল্প বয়সেরই খ্যাতির শিখরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন মাইকেল ফেল্পস। সাঁতারে একের পর এক স্বর্ণপদক জয় করে বিশ্ব দরবারে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন। কিন্তু ফেল্পসের মা জানান, মাত্র ৯ বছর বয়সে অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজওর্ডারে(ADHD) আক্রান্ত হয়েছিলেন ফেল্পস।
স্কুলে পড়াশোনায় মন বসাতে পারতেন না। চিকিত্সকের পরামর্শে ওষুধ ও সাঁতারের জেরে ধীরে ধীরে সমস্যা কাটিয়ে ওঠেন এ বিশ্বখ্যাত সাঁতারু।
প্রিন্সেস ডায়না : রূপকথার রাজকুমারী বলতে যা বোঝায় বাস্তবে রাজকুমারী ডায়না তার চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিলেন না। সৌন্দর্য্যের জন্য বিশ্বখ্যাত ডায়না ইচ্ছে করেই নিজের চারপাশের জগত্টাকে বদলে ফেলেছিলেন। প্রায় ১ দশক ধরে বালিমিয়ায় ভোগেন ডায়না।
এই সমস্যার জন্য সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে তাকে। মজার বিষয় বালিমিয়ার নামই পরে হয়ে যায় ‘ডায়না ইফেক্ট’। বালিমিয়ার কারণেই অবসাদে ভুগতে শুরু করেন ডায়না। জানা গেছে, এ কারণে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি।
শাহরুখ খান : বলিউড কিং শাহরুখও ভুগেছেন মানসিক সমস্যায়। সময়টা ২০০৮ সাল। শুটিংয়ের সময় কাঁধে মারাত্মক চোট পান এ তারকা অভিনেতা। এ কারণে অস্ত্রপচারও করাতে হয় তার। এরপর থেকেই গভীর অবসাদে ভুগতেন শাহরুখ।
ঘন ঘন সিগারেট খেতে থাকেন, স্নায়ুর সমস্যাতেও ভুগতে শুরু করেন। এখনো পুরোপুরি অবসাদের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মাঝে মাঝেই মানসিক কারণে বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতায় ভোগেন এ তারকা।
পারভীন ববি : বলিউড সিনেমার ইতিহাসে পারভীন ববি এক স্মরণীয় নাম। বলতে গেলে সত্তর-আশির দশকে বলিউডে রাজত্ব করেছেন এ অভিনেত্রী। সমসাময়িক তারকাদের তুলনায় আধুনিকতায় বেশ কয়েক দশক এগিয়ে ছিলেন তিনি।
কিন্তু ভয়াবহ প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে নিজের চিকিত্সাও করান। একটি আশ্রমের সঙ্গেও যুক্ত হন। স্কিজোফ্রেনিয়া ও অবসাদের কারণে জীবনে ক্রমশ একা হয়ে গিয়েছিলেন পারভীন। পরবর্তীতে তার মৃত্যুকে ঘিরেও তৈরি হয় রহস্য।
মাইক টাইসন : বক্সিং রিংয়ে অপ্রিরোধ্য এক নাম মাইক টাইসন। তবে ছোটবেলা থেকেই অবসাদ ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন এ বক্সার। সারাজীবনই সেই স্মৃতি বয়ে বেরিয়েছেন তিনি। জীবনে সাফল্য যত এসেছে, ততই ঘিরে ধরেছে অবসাদ।
সে কারণেই হয়তো ২০০৫ সালে টাইসন বলেছিলেন, ‘আমি কোনোদিন খুশি হবো না। আমার বিশ্বাস আমাকে একা মরতে হবে। আমি সেটাই চাই। সারাজীবন আমার গোপন যন্ত্রনাগুলোর সঙ্গে আমি একাই কাটিয়েছি। আমি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছি, তবু নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করছি।’
অ্যাঞ্জেলিনা জোলি : হলিউডের খ্যাতিমান অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। সদা হাস্যজ্জ্বল এ অভিনেত্রী কিন্তু মোটেও এমন ছিলেন না। কৈশোরে নিজেকে নিয়ে আলাদা এক জগত তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই জগতেই ডুবে থাকতেন সব সময়। এ কারণে তাকে ঘিরে ধরেছিল অবসাদ। ফলস্বরুপ বহুবার নিজের হাত কেটে ফেলেছেন এ তারকা।
এখনো নাকি মাঝে মাঝে কাল্পনিক বন্ধুদের সঙ্গে রাতে কথা বলেন তিনি। জোলির নিরাপত্তারক্ষীর জানিয়েছিলেন মাঝে মাঝেই নাকি অতি তুচ্ছ কারণে ভেঙে পড়েন তিনি। মেয়ের অবসাদ নিয়ে জোলির বাবাও বেশ কয়েকবার মুখ খুলেছেন।
সঞ্জয় দত্ত : বলিউড অভিনেতা সঞ্জয় দত্তের সঙ্গে অপরাধ জগতের সম্পৃক্তার বিষয়টি সবার জানা। এ কারণে পরবর্তী সময়ে গভীর অবসাদে ভুগেছেন নব্বই দশকের `খলনায়ক` সঞ্জয়। সেইসঙ্গেই যোগ হয়েছিল বিবাহ বিচ্ছেদ, বাবার মৃত্যু।
ফলাফল মাদক সেবনে নিজেকে জগিয়ে ফেলেন এ তারকা। এ কারণে বেশ কয়েক বছর রিহ্যাবেও কাটাতে হয়েছে তাকে। তারপরই যেন নতুনভাবে জন্ম হয় সঞ্জু বাবার। খলনায়ক সঞ্জয় হন মুন্নাভাই।
মনীষা কৈরালা : সারল্য এবং অভিনয় দক্ষকতা এ দুইকে পুঁজি করে ৯০-এর দশকে বলিউডের প্রথম সারির অভিনেত্রী হয়ে উঠেছিলেন মনীষা কৈরালা। কিন্তু সেই মনীষাই ভুগতেন গভীর ক্লিনিকাল ডিপ্রেশনে। বোহেমিয়ান জীবন, অতিরিক্ত মদ্যপান সবকিছুর জেরে একা হয়ে গিয়েছিলেন। অনেকে ভেবেছিলেন বিয়ের পর একটু স্থির হবেন। কিন্তু হলো তার বিপরীত।
বাড়তে থাকে তার অবসাদ। এরপর ডিভোর্স, মারণরোগ ক্যানসার জীবনের খাদে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল মনীষাকে। কিন্তু চুপ করে থাকেননি তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় খুলে বলেছেন মনের কথা, যুদ্ধ করেছেন মৃত্যুর সঙ্গে। পাশাপাশি মনকে করেছেন স্থির। যুদ্ধ জয় করে রীতিমতো অন্য এক মনীশা হয়ে ফিরে এসেছেন সবার মাঝে।
দীপিকা পাডুকোন : বলিউডের প্রথম সারির নায়িকাদের একজন দীপিকা পাড়ুকোন। হলে কী হবে অবসাদের হাত থেকে রেহাই পাননি তিনিও। তবে তিনিই প্রথম অভিনেত্রী যিনি নিজের অবসাদ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলেছেন। অবসাদে ভোগার কারণ না জানালেও সেই সময়ে তার অনুভূতি, তার লড়াইয়ের গল্প তুলে ধরেছেন সকলের সামনে।
সাহস জুগিয়েছেন মানসিক ভাবে অসুস্থদের। নিজের পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গী ও পরিণত জীবনবোধের জেরেই অবসাদ কাটিয়ে উঠেছেন দীপিকা। পাশাপাশি অবসাদগ্রস্থ রোগীদের পাশে থাকার অঙ্গীকারও করেছেন এ তারকা অভিনেত্রী।