দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এখন বিশ্বে চলছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই। এই লড়াইয়ে আজ যে শত্রু কাল সে মিত্র। আবার শত্রুর শত্রুও হয়ে যাচ্ছে পরম মিত্র। এ এমন এক অবস্থা যখন যুক্তরাষ্ট্র নির্ধারিত গণতন্ত্রের পেছনে ছুটতে ব্যস্ত আমরা সকলে। কিন্তু দেশ-কাল ভেদে যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ভিন্নতা আছে তা মানতে নারাজ বিশ্ব মোড়লেরা। তবু এরই মাঝে কিছু দেশ-শহর যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের মডেলকে অস্বীকার করে নিজেদের বন্দোবস্ত নিজেরাই করে নিয়েছে। এই তালিকায় কিউবা, বলিভিয়া, বুরকিনা ফাঁসোসহ বেশ কয়েকটি দেশ অন্যতম। রাষ্ট্রের বাইরে কিছু শহরও আছে যাদের আছে নিজস্ব শাসন কাঠামো এবং জীবনযাপনের ভিন্ন পদ্ধতি।
ইউরোপভুক্ত দেশ স্পেনের দক্ষিণের একটি ছোটো শহর মারিনালেদা। গোটা স্পেনে বেকার জনগোষ্ঠি থাকলেও এই ছোট্টো শহরটিতে নেই কোনো বেকার যুবক-যুবতী। চর্তুপাশে সবুজ পাহাড় বেষ্টিত এই শহরটি সামগ্রিক স্পেন থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। এখানে সমাজতান্ত্রিক কায়দায় শাসন কাঠামো সাজানো হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই শহরটি যে প্রদেশে অবস্থিত সেই প্রদেশটি হলো স্পেনের সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থমন্দায় যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাভিশ্বাস উঠবার অবস্থা তখনও শান্তি বিরাজ করছিল মারিনালেদাতে। শহরটির মেয়র হুয়ান ম্যানুয়েল সানজেক গরডিল্লো পুঁজিবাদ বিরোধী অবস্থান থেকে সবসময়ই শহরের বাসিন্দাদের সম্মিলিত সমৃদ্ধির ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। আর তার এই অবস্থানের কারণে গোটা ইউরোপে তাকে ‘দ্য স্প্যানিশ রবিন গুড’ নামে ডাকা হয়। শহরে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তিনি স্থানীয় সুপারমার্কেটগুলোর কাছ থেকে বাজার নিয়ন্ত্রনের অধিকার কেড়ে নেন। সুপারমার্কেটগুলো থেকে তেল, চাল, বীজ ইত্যাদি গাড়িতে করে নিয়ে রাখা হয় স্থানীয় খাদ্য ব্যাংকে। এই ব্যাংক থেকে গরীব এবং অসহায়দের সহযোগিতা করা হয়।
এবিষয়ে মেয়র হুয়ানকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, ‘এটাকে আপনি চুরি বলতে পারবেন না। তারা নির্দেশ অমান্য করেছিল বিধার রক্তপাতহীন পন্থায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে। এখানে অনেক পরিবারই আছে যারা খাবার কেনার জন্য অর্থ খরচ করতে পারে না। একুশ শতকে মানব ইতিহাসের জন্য এটা সত্যিই অসম্মানের। খাবার প্রাপ্তি একটি অধিকারের প্রশ্ন।’ হুয়ান এই শহরের মেয়র হিসেবে নিযুক্ত আছেন ১৯৭৯ সাল থেকে।
উন্নত বিশ্বের একজন নাগরিককে কোনো জমিতে বাড়ি বানাতে গেলে রাষ্ট্রকে বিপুল পরিমান অর্থ দিতে হয়। কিন্তু মারিনালেদাতে মোট ছয় লাখ নব্বই হাজার ফাঁকা ভূমি থাকার পরেও এই ভূমি নিয়ে বাণিজ্য করছেন না মেয়র। উল্টো এই শহরে যদি কেউ বাড়ি বানাতে চান তাহলে সরকারকে দিতে হচ্ছে না কোনো অর্থ। টাউনহলের তালিকায় থাকা শ্রমিকরাই একটি নির্দিষ্ট মজুরির বিনিময়ে সেই বাড়ি তৈরি করে দিতে প্রস্তুত থাকে সবসময়। গোটা শহরের জনগোষ্ঠি এখন মাত্র দুই হাজার ৭০০ জন। শহরের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ১২০০ ইউরো। শহরে কোনো বেকার না থাকার কারণে দুর্নীতি কিংবা অপরাধ ঘটার হার নেই বললেই চলে। আর তাই শহরের নিরাপত্তার জন্য দরকার হয় না কোনো পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনীর।
শহরবাসীর নৈতিকতার প্রশ্নে মেয়র হুয়ান বলেন, ‘আমাদের মূল্যবোধ নিয়ে পুনরায় ভাবার সময় এসেছে। এই পণ্যভিত্তিক সমাজে আমাদের মূল্য নির্ধারিত হয় অর্থ, ব্যাক্তিস্বার্থ ও ব্যাক্তিসাতন্ত্রতা দ্বারা। মারিনালেদা একটি ছোটো উদাহরণ মাত্র এবং আমরা চাই বিশ্ব এই উদাহরণকে সামনে রেখে এগিয়ে যাক।’