পারভিন সুলতানা দিতি আশির দশকের শেষের দিক আর নব্বইয়ের শুরুতে ঢাকাইয়া সিনেমার শুধু পরিচিত মুখই ছিলেন না; বলা চলে ঢালিউড সে সময় শাবানা ও দিতির উপর নির্ভর ছিল।
আর শাবানা মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে গেলে পুরো নির্ভর হয়ে পড়ে দিতির উপর। তবে সে যাত্রায় খৈ হারিয়ে ফেলেন দিতি। একসময় দেশ ছেড়ে পাড়ি জমান সুদূরে। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে দেশে ফিরেনও বটে। তবে, বেশ দেরি হয়ে গেছে। কেননা, এর কিছুদিন পরই ঢাকার সিনেমার মান অবনমন শুরু হতে যাচ্ছিল। আর সে সিনেমার সাথে নিজেকে মানানোর চেষ্টা না করে আস্তে আস্তে সরে সরে যেতে থাকলেন দিতি। তবে, এ নিয়ে অভিযোগও আছে দিতির বিরুদ্ধে।
বিদেশফেরত দিতিকে নিয়ে কাজ করতে ভয় পেত পরিচালকরা। আবার কখন বিদেশে চলে যায়। অবশ্য দিতির ভাষ্য ছিল, তার মধ্যে কাজের সততা ছিল। দেশে ফেরে একসঙ্গে সাইন করা ১২টি সিনেমার কাজই শেষ করেছিলেন দিতি।
পরিচালকদের অভিযোগের জবাব দিতি দিলেও তার অভিনয় করা প্রথম ছবি যে এখনও মুক্তি পায়নি তা নিয়ে অবশ্য বেশ দুঃখ থাকাটা স্বাভাবিক দিতির। ১৯৮৪ সালে ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ কার্যক্রমের মাধ্যমে ঢাকাই সিনেমাতে পদার্পণ করেন তিনি। উদয়ন চৌধুরী পরিচালিত ‘ডাক দিয়ে যাই’ ছিল দিতির ক্যারিয়ারের প্রথম সিনেমা। কিন্তু সিনেমাটি মুক্তি পায়নি।1
দিতি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আমিই ওস্তাদ’, আর পরিচালক ছিলেন আজমল হুদা মিঠু। এ ছবিতে দিতির অনবদ্য অভিনয় দর্শকদের বেশ নজর কাড়ায় আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
এরপর দর্শকদের বহু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র উপহার দিয়ে গেছেন ঢাকার সিনেমার সোনালি যুগের এ নায়িকা। এরপর ২৮ বছরে প্রায় দুইশটির মত ছবিতে অভিনয় করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘স্বামী-স্ত্রী’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য এ পুরষ্কার ঘরে তুলেন তিনি। এ ছবিতে দিতি আলমগীরের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেন।
দাম্পত্য জীবনে দিতি
সিনেমায় দিতি সবচেয়ে বেশিসংখ্যক জুটি আবদ্ধ হয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে। এ জুটির প্রাণবন্ত অভিনয় গোগ্রাসে দর্শকরা গিলে ফেললেও বাস্তব জীবনে প্রাণবন্ত হতে পারেনি এ জুটির সংসার। দুজনেরই ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। তবে, ডিভোর্সেই পরিসমাপ্তি ঘটে কাঞ্চন-দিতির সংসার।
তার আগে দিতি প্রথম বিয়ে করেছিলেন ১৯৮৬ সালে। বর চলচ্চিত্রেরই মানুষ সোহেল চৌধুরী। নতুন মুখের সন্ধানে কার্যক্রম দিয়ে দিতির সঙ্গে একই সময়ে পা বাড়ান এ জগতে। চলচ্চিত্রে আসার পর প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক এফ কবীর চৌধুরী সোহেল চৌধুরীকে ‘পর্বত’ নামের ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। ওই ছবিতে তার বিপরীতে নায়িকা ছিলেন দিতি। দুজনের অভিনয় প্রশংসিত হয়েছিল। এর পরের বছর ১৯৮৫ সালে আমজাদ হোসেনের ‘হীরামতি’ ছবিতে অভিনয় করেন সোহেল। এই ছবিতেও তার নায়িকা দিতি। এই ছবিতে অভিনয় করতে গিয়েই প্রেমে পড়েন দুজন। এরপর সাতপাঁকে বাধা পড়েন।
সোহেল চৌধুরীর সঙ্গে দিতির প্রথম সংসার
১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাত দুটার দিকে সোহেল চৌধুরী খুন হন বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে। আর এ খুনের ঘটনা সারাদেশে বেশ আলোচনায় আসে। এ খুনের রহস্য আজও কিনারা হয়নি। কিন্তু তার পূর্বেই দিতি-সোহেলের ঘর ভেঙেছিল। তাদের ঘরে ১৯৮৭ সালে জন্ম নেন মেয়ে লামিয়া চৌধুরী আর ১৯৮৯ সালে জন্ম নেয় ছেলে দীপ্ত। মেয়ে কানাডা থেকে মেকিং নিয়ে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফিরেছেন দেশে।
দীপ্ত নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এ দুই সন্তান নিয়েই দিতির জ্ঞান-ধ্যান। সন্তানদের নিয়ে গুলশানে বসবাস দিতির।
গেল বছরের শুরু থেকেই অসুস্থতা অনুভব করছিলেন চলচ্চিত্রের ব্যস্ততম এই অভিনেত্রী। পরে অসুস্থতা তীব্রতর হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। আশানুরূপ কোনো ফল না পেয়ে ভারতে যান। সেখানেই ধরা পড়ে তার ব্রেইন টিউমার, এরপর অপারেশন।এরপর কয়েক দফা ভারতে চিকিৎসা করান।
তিনি দীর্ঘদিন ভারতের চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব অর্থোপেডিকস অ্যান্ড ট্রমাটোলজি(এমআইওটি) হাসপাতলে আশংকাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৮ জানুয়ারি বিকেল ৪টার দিকে প্রায় তিন মাস পর ছেলে শাফায়াত ও মেয়ে লামিয়া সহ ঢাকায় ফিরেন তিনি। শারীরিকভাবে আগের অবস্থায়ই রয়েছেন দিতি।
জানা যায়, ঢাকায় ফেরার পর তাকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।সেখানে তিনি নিবির পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় অভিনেত্রী পারভিন সুলতানা দিতির শারীরিক অবস্থার সংকটাপন্ন।
অসুস্থ হওয়ার আগে দিতি দুটি নতুন ধারাবাহিক নাটকে কাজ করছিলেন। একটি ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ এবং অন্যটি ‘মেঘে ঢাকা শহর’। পাশাপাশি তিনি বদিউল আলম খোকন পরিচালিত ‘রাজা বাবু’ ছবির কাজও করছিলেন।