সিনেমায় নয়, বাস্তবেই দেহ দিবেন ঋতুপর্ণা!

0

03নাহ! কোনো সিনেমা নয়। বাস্তব জীবনের গল্প। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত মনে মনে তৈরি। আগামীকালই অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন তার দেহ দানে। দেবদূত ঘোষ পরিচালিত দেহদানবিষয়ক ছবির প্রথম প্রদর্শন উপলক্ষে। সিনেমার নায়িকার সৌন্দর্য, রূপ-লাবণ্য নিয়ে আমাদের প্রত্যাশার বুঝি শেষ নেই। রূপ হবে দেবীর মতো, ত্বক হবে বেবির মতো, চাহনি হরিণীর মতো, পীনোন্নত বক্ষে তিনি হার মানাবেন গ্রীক দেবী হেলেনকে, নিতম্বের গুরুতায় পিছনে পড়ে যাবে কালীদাসের ঊমার বর্ণনা, হাসিতে তাঁর বিভঙ্গের কথা মনে পড়লে ঘুমের ওষুধেও কাজ হবে না, তাঁর চোখে জল দেখলে জল আসতেই হবে আপনার চোখেও। আরও…আরও…আরও অনেক ফ্যান্টাসি তাঁকে ঘিরে, তাঁর শরীর ঘিরে। কিন্তু সেই তাঁর অবর্তমানে যদি তাঁর চাহনি অন্য কারও চোখে মেলে? কিংবা তাঁর মতোই ত্বকের মসৃণতা যদি হঠাৎ অন্য কারও দেহে দেখে চোখ পিছলে যায়?

এমন হতেই পারে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর ক্ষেত্রে। মৃত্যুর পর দেহটা দান করে যাওয়ার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যিনি। তিনি চান তিনি যখন এ পৃথিবীতে থাকবেন না, তখন তাঁর চোখে অন্য কেউ পৃথিবীকে দেখুক, তাঁর কিডনির শক্তিতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করুক, তাঁর ত্বক প্রতিস্থাপিত হোক কারও দেহে, যাঁর সেটা প্রয়োজন।

আগামী রবিবার অর্থাৎ ৮ জুন হরিশ মুখার্জি রোডের গোখেল মেমোরিয়ালের সরলা মেমোরিয়াল হলে আনুষ্ঠানিকভাবে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ হবেন তিনি। আর ওই হলেই প্রদর্শিত হবে মরণোত্তর দেহদান নিয়ে দেবদূত ঘোষের তৈরি তথ্যচিত্র ‘প্রাণ থেকে প্রাণে।’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনে থাকবেন স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ, যিনি আগেই দেহ দানের ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। উপস্থিত থাকবেন কৌশিক সেন, সমীর আইচ, গৌতম মোহন চক্রবর্তী, ড. অশোক চৌধুরীসহ অনেকেই।

হঠাৎ এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন? প্রশ্নে ঋতুপর্ণা বললেন, “চক্ষুদানের ইচ্ছে আমার অনেক দিনই ছিলো। দেহ দানের সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললাম। মানুষ যখন মারা যায়, জীবন যখন শেষ হয়ে যায়, তখন আর দেহটার প্রয়োজন কী? কিন্তু তখন যদি কোনো জীবন্ত মানুষের উপকারে দেহটা আসতে পারে, তার চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? তাছাড়া ফিলজফিকালিও তো দেহ পড়ে থাকে, আত্মা পরমাত্মায় বিলীন হয়ে যায়।

দেহটা তো দান করে যাওয়াই ভালো অন্যের জন্য। আমি বরাবরই গিভিং পারসন। নেওয়ার থেকে দেওয়ায় অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। অন্যের উপকার করার চেষ্টা করেছি সাধ্য মতো। যদি মৃত্যুর পরও কারও উপকারে আসতে পারি, সেটা তো ভীষণ আনন্দের। মৃত্যুর পরে নিজের দেহটা তো আর আমার কোনো কাজে লাগবে না। কিন্তু অন্যের কাজে তো আসবে!”

এমন সিদ্ধান্তের পিছনে পারিবারিক কোনো অনুপ্রেরণাও কি রয়েছে? প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার ফুফা ড. কল্যাণময় সেন বিজ্ঞানী ছিলেন। তিনি দেহদান করেছিলেন। তা ছাড়া আমার এক মাসিও দেহদান করেন। বাড়ির অনেকেই চক্ষুদানও করেছেন। তাঁরা অবশ্যই আমার ইনস্পিরেশন।” আর এই সিদ্ধান্তে শ্বশুরবাড়িতে কেউ আপত্তি করেননি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখনও সবার সঙ্গে কথা হয়নি।

তবে আমার শ্বশুরমশাই ডাক্তার ছিলেন, শাশুড়িও ডাক্তার। দেহ দানের ব্যাপারে এখানে কেউ আপত্তি করবেন বলে মনে হয় না।” ঐশ্বর্য রাই চক্ষুদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনেকেই চোখ দান করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এবার তাঁকে দেখেও কি অনেকে দেহদানে অনুপ্রেরণা পাবেন? প্রশ্নে ঋতু বলেন, “যদি সেটা হয়, খুব খুশি হব।”

দেবদূত ঘোষ যে তথ্যচিত্রটি বানিয়েছেন তার মেয়াদ ২২ মিনিট। এ ব্যাপারে তাঁকে সাহায্য করেছেন ভারতে দীর্ঘদিন ধরে দেহ দান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্রজ রায়। তাঁর ‘গণদর্পণ’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষ দেহদানে ব্রতী হয়েছেন এবং এখনও হচ্ছেন। ব্রজবাবুর থেকে জানা গেল, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, চিত্রা সেন, শোভা সেন, ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীরাও দেহ দানে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন আগেই। আবার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, বিমান বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সূর্যকান্ত মিশ্ররাও নাম নথিভুক্ত করেছেন এ ব্যাপারে। নায়িকার ত্বক-ও কি কারও দেহে শোভা পেতে পারে?

ব্রজবাবু বলছেন, “হ্যাঁ, চামড়া ভালো থাকলে অবশ্যই তা ভালোভাবে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। এই তো কিছুদিন আগে ফল্গু মজুমদার নামে এক মহিলার চামড়া প্রতিস্থাপন করা হলো একজনের দেহে!”

দেহদান এবং তা নিয়ে ডকুমেন্টারি বানানোর ব্যাপারটা কেমন করে মাথায় এলো? প্রশ্নে দেবদূত বলেন, ‘ব্রজ দা-র মতো মানুষরা যে আন্দোলনটা শুরু করেছেন, সেটাকে আরও খানিক এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদ থেকেই আমি এই কাজে হাত দেই। কাজটায় ব্রজ দা তো বটেই, ওই সংগঠনের তৃপ্তি চৌধুরীও স্ক্রিপ্ট বানিয়ে সাহায্য করেছেন। তা ছাড়া যে কলাকুশলীরা কাজ করেছেন তাঁরাও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেছেন। ছবিতে চৈতি ঘোষাল এক দিদি মণির ভূমিকায় আছেন। পাঠ ভবন স্কুলের ছাত্ররাও কাজ করেছেন।”

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More