[ads1]তাঁর দুচোখে জল টলমল করছে। দৃষ্টিতে বিহ্বলতা! চরাচরের সব বিষাদ যেন একাই ধারণ করেছেন। অযত্নে লালিত ঘাসের মতো শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখখানিতে হতাশা, দুঃখ, অবিশ্বাস। লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। বর্তমান পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়! সেই মেসি কিনা ব্যর্থ হলেন টাইব্রেকারে গোল করতে! তাঁর বল গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে চলে গেল আকাশে। সঙ্গে সঙ্গেই যেন হাতছাড়া হয়ে গেল আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জেতার সবটুকু সম্ভাবনা। চিলি-শিবিরে তখন লাল উল্লাসের শুরু। তখনই কি মেসি জেনে গিয়েছিলেন ট্র্যাজেডির সূত্র—পরাজয় পূর্বনির্ধারিত থাকে ট্র্যাজেডির নায়কদের জন্য। গায়ের আকাশি-সাদা জার্সিটা কলারে ধরে টেনে তুলে মুখটা ঢাকতে চাইলেন একবার।
যখন সব শেষ, সবাইকে ছেড়ে নীরবে মাঠ থেকে চলে গেলেন মেসি। বসলেন মাঠের পাশে, খেলোয়াড়দের আসন-সারিতে। সেখান থেকে শূন্যদৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন। আমেরিকা থেকে অনেক দূরে বাংলাদেশের টেলিভিশনের সামনে আমরা যারা বসে ছিলাম, আমাদের মনে হলো, তিনি যেন দেখেও কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। বার্সেলোনার সহ-খেলোয়াড়, সেই মুহূর্তে বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী দলের অধিনায়ক ব্রাভো একবার চলে এলেন তাঁর কাছে। তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন।
বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন মেসি। তাঁর সেই কান্না সংক্রমিত হলো দেশে দেশে। বাংলাদেশে কোটি আর্জেন্টিনা-সমর্থক যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না নিজের চোখকে। কিন্তু তাঁদের প্রিয়তম খেলোয়াড়টিকে কাঁদতে দেখে তাঁরাও অজান্তেই চোখ মুছতে লাগলেন। মেসি যে এই গ্রহের কেউ নন। তাঁর পা দুটো যেন মর্ত্যের ধূলিমাটি স্পর্শ করে না। এবারের কোপা আমেরিকাতেও যিনি খেলেছেন অপূর্ব সুন্দর সব খেলা। এই কাপেই তাঁর দুটো ফ্রি-কিকের গোল সত্যিকারের জাদুকর ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব বলে ভাবা যায় না। এই কাপেই তিনি ভঙ্গ করেছেন গোলের রেকর্ড। আর্জেন্টিনার পক্ষে তিনি সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা। বার্সেলোনার হয়ে বার্সেলোনাকে এনে দিয়েছেন কত কত ট্রফি। অমন যে নায়ক, তিনি কাঁদছেন। এই বুঝি লেখা ছিল বিধিলিপিতে। সবই তিনি পারবেন, শুধু পারবেন না আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে কোনো শিরোপা জিততে!
খেলা শেষে সাংবাদিকদের তিনি তাই বলেছেন, তাঁকে আর দেখা যাবে না আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে। বলেছেন, এ সিদ্ধান্ত ভেবেচিন্তে নেওয়া। এটা তো প্রমাণিত, তিনি জাতীয় দলের হয়ে কাপ জিততে পারেন না। চারবার ফাইনালে উঠেছে তাঁর দল, কিন্তু প্রতিবারই তাদের মেনে নিতে হয়েছে রানার্সআপের বিধিলিপি। টুইটারে আগুয়েরো বলেছেন, মেসিকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মেসির জন্যও পরাজয় সবচেয়েই কষ্টের। আমাদের মধ্যে অনেকেই তাঁকে অনুসরণ করে অবসর নেবেন।
মেসির একজন ভক্ত টুইটারে লিখেছেন, ‘অনেকেই আছে, যারা পরপর চারবার ফাইনালে ওঠাকেই সাফল্য বলে মনে করবে। মেসি তার শ্রেষ্ঠত্বের বলি।’ পাঁচ-পাঁচবার ফিফার বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের ব্যালন ডি’অর বিজয়ী তিনি। বার্সেলোনার হয়ে তিনি জিতেছেন ২৮টি শিরোপা। অনেকে মনে করেন, তিনিই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার। কিন্তু আর্জেন্টিনার ভক্তরা সমর্থকেরা সান্ত্বনা পান না—তিনি কেমন সেরা, যিনি দেশকে ট্রফি এনে দিতে পারেন না![ads1]
এখানেই হয়তো সুন্দরের সঙ্গে পার্থক্য বীরের। মেসি শিল্পিত, মেসি যখন বল নিয়ে ছোটেন, মনে হয় যেন প্রজাপতি ছন্দ পেয়েছে তার পাখনায়। কিন্তু ধরা যাক ম্যারাডোনা। তিনি তো কেবল দক্ষ নন, তিনি মারকুটে, জয় ছিনিয়ে নেওয়ার নেশা তাঁকে রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘের মতো ক্ষিপ্ত করে তুলত। আমাদের মনে পড়বে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে (সেই ’৮৬ বিশ্বকাপে) ম্যারাডোনার ছুটে যাওয়া মধ্যমাঠ থেকে, গোল করে তবে তিনি ফিরেছিলেন। আর তাঁর সেই ‘ঈশ্বরের হাতের’ গোলটিও প্রমাণ করে তাঁর মরিয়া মনোভাব। তুলনায় মেসি সত্যি সত্যি যেন দেবদূতের মতো—সুন্দর, শিষ্ট, নিষ্পাপ। তা দিয়ে শিল্প রচনা করা যায়, চ্যাম্পিয়ন হওয়া কঠিন।
গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তারকা খেলোয়াড়দের পেনাল্টি শট মিস আমরা আমাদের কালেই বহুবার দেখেছি। আমাদের মনে পড়ে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপে জিকোর পেনাল্টি মিস, সক্রেটিসের মিস। দেখেছি ফ্রান্সের প্লাতিনিকেও মিস করতে। স্প্যানিশ টুর্নামেন্টে পেনাল্টি মিস করতে দেখেছি ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে, এমনকি মেসিকেও। বাজ্জো, বেকহাম, রোবেন—পেনাল্টি মিসের তালিকায় বিখ্যাতরা কেউ কম যাননি।
কাল মেসির ওপর কী চাপ ছিল আমরা বোঝার চেষ্টা করি। তিনি আসলেই কোপা আমেরিকা জিততে চেয়েছিলেন। এ কথা তিনি অনেকবারই বলেছেন, আর্জেন্টিনার হয়ে তিনি কাপ জিততে চান। ১২০ মিনিট গোলশূন্য। চিলির প্রথম শটটাও ঠেকিয়ে দিলেন আর্জেন্টিনার গোলরক্ষক রোমেরো। এরপর শট নিতে গেলেন মেসি। বল চলে গেল গোলপোস্টের বাইরে দিয়ে। ব্যর্থ হয়ে প্রমাণ করলেন, তিনি এই গ্রহেরই একজন।
কিশোর মেসির একটা ভিডিও আছে অনলাইনে। তাতে তিনি বলছেন, তাঁর জীবনের স্বপ্ন হলো আর্জেন্টিনার হয়ে খেলা। এর আগে তিনি বলেছেন, তিনি জানেন, স্পেন তাঁকে তাদের দলে চায়। কিন্তু নিজের জন্মভূমি আর্জেন্টিনা যে তাঁর কাছে সবার ওপরে।
নিজের দেশকে যে একটা চ্যাম্পিয়ন ট্রফি উপহার দিতে পারলেন না, সেই শোকেই বুঝি মেসির এই কান্না। মাত্র ২৯ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা বুঝি সেই আক্ষেপ থেকেই। বিয়োগান্ত মহাকাব্যের শেষ দৃশ্য কি ২৬ জুন ২০১৬ (আমেরিকার সময়), ২৭ জুন (বাংলাদেশ সময়) মেটলাইফ স্টেডিয়ামেই সম্পন্ন হয়ে গেল? নাকি মুহূর্তের শোক ভুলে আবার আকাশি রঙের জার্সি গায়ে মেসি নামবেন মাঠে? রাশিয়া বিশ্বকাপটা তিনি যদি এনে দিতে পারেন আর্জেন্টিনার ঘরে, তাহলেই হয়তো এই ফুটবল-বীরের জন্য সবচেয়ে মানানসই হয়। নাকি তিনি কালের কপোলতলে এক শুভ্র সমুজ্জ্বল অশ্রুবিন্দু হয়েই রয়ে যাবেন![ads2]
Prev Post
Next Post