স্পন্সর সাহারার মুখে কালি, আমাদের?

0

Sahara_Mukhe_Kali-300x193খেলা ডেস্কঃ ভারতের সাহারা গ্রুপের প্রধান সুব্রত রায় গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশি হেফাজতে ছিলেন। এরপর আদালতে হাজির হতে গিয়ে মুখে কালিও খেলেন। এই কালি কি আর কোথাও লাগল? এশিয়া কাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে দারুণ খেলেও হেরেছে বাংলাদেশ, কিন্তু সেঞ্চুরি করেছেন আমাদের এনামুল। সেদিনের হার আমাদের কাঁদিয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাওয়াও ছিল অনেক।

দেশের বহূল প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোতে  লিড ছবিটিও তাই সেঞ্চুরির পর দুই হাত প্রসারিত এনামুলের ছবিটি, মুখে তৃপ্তির হাসি। কিন্তু তাঁর বুকে জ্বলজ্বল করছে ‘সাহারা’, নিচে লেখা বাংলাদেশ। দিল্লিতে মনোজ শর্মা নামের যে ব্যক্তি সাহারাপ্রধান সুব্রত রায়ের মুখে কালি ছুড়ে মারলেন, সেই কালি কি আমাদের গায়েও একটু লাগল না!

বিভক্তির এই দেশে ক্রিকেটের যেকোনো সাফল্যই আমাদের পুরো দেশকে আনন্দে ভাসায়, ব্যর্থতা আমাদের কাঁদায়। ৪ মার্চ আমাদের কাঁদিয়েছে। ক্রিকেট দলটি নিয়ে আমাদের আবেগের মাত্রাটা এমনই। এমন আবেগের দলটির বুকে আমরা সেঁটে দিয়েছি সাহারার নাম! ‘সুব্রত রায় চোর, সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ তিনি চুরি করেছেন’—সুব্রত রায়ের মুখে দোয়াতের কালি ছুড়ে মেরে চিৎকার করে এ কথাই বলছিলেন মনোজ। ওপরে ‘সাহারা’ ও নিচে ‘বাংলাদেশ’ বুকে নিয়ে খেলতে নামে আমাদের যে ক্রিকেট দলটি, সেই সুব্রত রায় সাহারার স্থান আপাতত ভারতের সবচেয়ে ‘বিখ্যাত’ তিহার জেল।

সুব্রত রায় সাহারা যে হঠাৎ করেই বিতর্কিত হয়েছেন, বিষয়টি তা নয়। ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের তালিকায় অনেক আগে থেকেই তাঁর নাম রয়েছে। ভারতের ব্যবসায়ী মহলে তাঁর সম্পর্কে যে বিষয়টি চালু আছে, তা হচ্ছে সাহারা গ্রুপের খুব কম বিনিয়োগই লাভ করতে পেরেছে। কিন্তু সুব্রত রায় জানেন কীভাবে নিজেকে সব সময় ‘পাদপ্রদীপের আলোয়’ রাখতে হয়, কীভাবে সঠিক রাজনৈতিক যোগাযোগটি বজায় রাখতে হয়।

২০১২ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন সুব্রত রায় সাহারা। তখনই তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের জার্সিতে সাহারার নাম ওঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে যান। আর বাংলাদেশে আবাসন খাতে বিনিয়োগের জন্য সমঝোতা স্মারক সই করেন সরকারের সঙ্গে। পুরো একটি ‘নতুন ঢাকা’ গড়ে তোলার জন্য সাহারার চাওয়া হচ্ছে, ঢাকার আশপাশে অন্তত ১০০ একর থেকে এক লাখ একর জমি। বিনিয়োগের পরিমাণ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশে ব্যবসা করার আকাঙ্ক্ষা নিয়েই ক্রিকেট দলকে স্পনসর করতে এগিয়ে এসেছে সাহারা গ্রুপ।

বাংলাদেশ যেমন বিদেশি বিনিয়োগ চায়, তেমনি ক্রিকেট দলের জন্যও স্পনসর প্রয়োজন। কিন্তু বাছবিচার বলে কি কিছু থাকবে না? যারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবে, তাদের আর্থিক সংগতি, সুনাম, অতীতের রেকর্ড—এসব যেমন বিবেচনার বিষয়, তেমনি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বুকে কোন নামটি থাকবে, সেটা বিচার-বিবেচনার মানদণ্ডও তো থাকা প্রয়োজন। নাকি শুধু বেশি অর্থ দিতে পারলেই যে কারও নাম আমাদের ক্রিকেট দলের বুকে ওঠানো যাবে?

সুব্রত রায় সাহারা ২০১২ সালে বাংলাদেশে আসার পর একটি লেখা লিখেছিলাম ভারতের এই বিতর্কিত ব্যবসা গ্রুপ সাহারা ইন্ডিয়া পরিবার নিয়ে। এই গ্রুপ সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছিলাম তখন। লিখেছিলাম, ‘সাহারা গ্রুপের খুব কম বিনিয়োগই যদি লাভের মুখ দেখে থাকে তবে এই প্রশ্নটি খুবই স্বাভাবিক যে তবে এত অল্প সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি এত বড় হলো কী করে? অবকাঠামো, আবাসন, গণমাধ্যম ও বিনোদন, ভোগ্যপণ্যের খুচরা বিপণন, হোটেল, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের মতো নানা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকলেও মূল ব্যবসাটি আসলে অর্থ নিয়ে, আর্থিক ব্যবসা। নানা ডিপোজিট স্কিমের ব্যবসা। সাহারা মাইনর, সাহারা সুপার বা সাহারা এমআইএস—এ ধরনের নানা ডিপোজিট স্কিমের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে সাহারা ইন্ডিয়া ফিন্যান্সিয়াল করপোরেশন। এই ডিপোজিট স্কিমের কোনোটির প্রতিদিনের কিস্তি এক রুপি! ১০০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশ ভারতে এভাবে অর্থ সংগ্রহের চেয়ে সহজ পথ আর কী হতে পারে। বিষয়টা অনেকটা যেন বাংলাদেশের ডেসটিনির অর্থ সংগ্রহের মতোই। ভারতের আর্থিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ নাকি এখন বাংলাদেশের এমএলএম কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সাহারার তুলনা করছেন। কারণ, একই ধরনের অবৈধ ব্যাংকিংয়ের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।’

সাহারা গ্রুপের এভাবে অর্থ তোলা নিয়ে ২০০৮ সালেই প্রশ্ন তোলে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। ব্যাংকটির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এই ক্ষুদ্র আমানতকারীরা খুব স্বাভাবিক কারণেই অসংগঠিত এবং তারা ‘সাহারা গ্রুপ ও তাদের এজেন্টদের কাছে জিম্মি’। করপোরেট ফ্রড ওয়াচ নামের একটি ওয়েবসাইট বলছে, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই সারা ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে অবৈধভাবে আমানত সংগ্রহ করে নিজেদের সম্পদ গড়ে তুলেছে। সাহারা সম্পর্কে এসব তথ্য কোনো লুকানো বিষয় নয়। বাংলাদেশ ক্রিকেটের কর্তাব্যক্তিদের কাছে কি এসব কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়?

লেখাটি শেষ করছি, অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদের ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি লিখেছিলেন, ‘ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যে ব্যবসায়িক গোষ্ঠীকে জালিয়াতির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন, গরিব সঞ্চয়কারীদের ২০ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের মামলায় যার মালিকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন, সেই SAHARA নাম বুকে ধারণ করে, বাংলাদেশ নামের ওপরে তাকে স্থান দিয়ে, খেলছে বাংলাদেশের ক্রিকেট দল। গ্রেপ্তারের ভয়ে এখন পালিয়ে বেড়ানো এই লোক বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশে এসেছিলেন লাখ একর জমি পাওয়ার আবদার নিয়ে। তখনই ক্রিকেট দলের ওপর এই আছর হয়। কত কোটি টাকা পেয়েছে ক্রিকেট দল এক জালিয়াত প্রতারকের নামে নিজেকে পরিচিত করতে? সেই টাকার কি খুব অভাব? কেউ যদি, সে ব্যক্তি হোক আর জাতি হোক, নিজেকে সম্মান করতে না শেখে, তাকে অন্যরা সম্মান করবে কেন?’

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More