বিশ্ব বাণিজ্যে চীনের অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠেছে বহুদিন ধরেই। কিন্তু মনের সূচকে তাদের ঘোর অন্ধকার। মনের মতো সঙ্গিনী ছাড়া অর্থ দিয়ে আর কী-ই বা হবে। যে কজনের দেখা পাওয়া যায়, প্রতিযোগিতার তালে তাদের সামনে দাঁড়ানোরই সাহস হয় না সাধারণ কোনো যুবকের। পাঠক, চীনে চলছে মারাত্মক পাত্রী সঙ্কট। বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেলেও কনে জুটছে না অগণিত চীনা পুরুষের কপালে। এক-দুই লাখ নয়, এ বছরের মধ্যে ‘কনের অভাবে ব্যাচেলর’ চীনা পুরুষের সংখ্যা ছাড়িয়ে যাবে চার কোটি!
যে চীনে একসময় নারীদের দেখা হতো ‘আবর্জনা’ হিসেবে সেই চীনজুড়ে এখন নীরব হাহাকার চলছে নারীদের জন্য। নারী আর পুরুষের সংখ্যার পার্থক্যটা এত বেশি আগে কখনও দেখা যায়নি দেশটিতে। প্রতি একশ মেয়ের বিপরীতে জন্ম হচ্ছে ১২২টি ছেলে শিশুর। এভাবে অসংখ্যা ‘২২’ জমে জমে পার্থক্যটা দাঁড়িয়েছে ৩-৪ কোটির ভেতর। চীনাদের ‘এক সন্তান নীতি’ যেন এখন মড়ার ওপর খাড়ার ঘা। একটির বেশি সন্তানের জন্ম হলে রাজ্যের ঝামেলা আর খরচ এসে হাজির। একসময় এসব চিন্তা করায় এখন কড়ায় গন্ডায় এর মূল্য দিতে হচ্ছে চীনা পুরুষদের। ‘সবকিছু’ থাকা সত্বেও চীনের পুরুষদের একটি বড় অংশকে আজীবন চিরকুমারই থাকতে হবে। মাথায় যত বুদ্ধিই থাকুক, জনসংখ্যার এই বৈষম্যমূলক বণ্টন থেকে পরিত্রাণের আপাতত কোনো পথ খোলা নেই চীনের সামনে। আর তাই টাকা কিংবা প্রেমের জোর, যে যেটা পারছে সেটা খাটিয়েই মরিয়া হয়ে খুঁজছে সংসারের সঙ্গী।
* ব্যাচেলর গ্রাম:
চীনের হুনান প্রদেশে ‘ডা জিন’ নামে একটি গ্রাম আছে। গ্রামটিতে ঢোকার পর থেকেই মনে হবে চারপাশে কেমন যেন নীরব নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। কোন হই হুল্লোড় নেই। তরুণ-যুবকদের বেশিরভাগকেই দেখা যাবে হতাশ হয়ে বসে আছে কিংবা কোনো কাজে গভীর মনোযোগী হবার ভাণ করছে। আসল ব্যাপারটা হলো পুরো গ্রামে নেই কোনো অবিবাহিতা নারী। হিসেব করে দেখা গেল গোটা গ্রামে বিয়ের উপযুক্ত পাত্র আছে শখানেক। কিন্তু সবাই মোটামুটি নিশ্চিত যে এদের কারো কপালে এ যাত্রা আর পাত্রী জুটবে না। ‘ডা জিন’র মতো চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অসংখ্য গ্রাম আছে যেগুলোকে আক্ষরিক অর্থেই ‘কুমারিশূন্য’ বলা চলে। গুয়াংজি প্রদেশের তানঝেন নামের গ্রামে ৬০ জন মধ্যবয়সীর সন্ধান পাওয়া গেছে, যারা পাত্রীর অভাবেই কুমার থেকে যেতে বাধ্য হয়েছেন। বাকি জীবনটা যে এদের একাই কাটবে, সেটাও পুরোপুরি নিশ্চিত।
* পণের পরিমাণ ও পাচার:
‘ডা জিন’ গ্রামের ব্যাচেলর জিন। ছয় বছর আগেই তার বিয়ে করার কথা ছিল। কিন্তু বিয়ের কিছু দিন আগেই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন জিন। কণের জন্য জমিয়ে রাখা পণের টাকা চলে যায় হাসপাতালের বিলে। টাকা নেই তো বিয়েও হবার নয়। কেননা, চীনের গ্রামগুলোতে এখনও বিয়ে করতে হলে মেয়ের পরিবারের হাতে তুলে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা। জিন আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন, আগে দেখে এসেছি এক বস্তা আলু আর একটি ছাগল দিলেই বিয়ে করা যেত, এখন সাত-আট হাজার ইউয়ান (এক-দেড় হাজার ডলার) ছাড়া বিয়েই হয় না। যা কিনা গ্রামের এক দরিদ্র চীনার সাত বছরের সঞ্চয়ের সমান! আর ঠিক এ কারণেই এখন চীনাদের বিয়ের জন্য এশিয়ার নানা দেশ থেকে নারী পাচার বেড়েছে। পাচারকারীরা নারীদের কাজ দেওয়ার নাম করে কিছু টাকার বিনিময়ে ‘স্ত্রী’ হিসেবে বিক্রি করে দিচ্ছে দরিদ্র চীনাদের কাছে। বিশেষ করে যেসব গ্রামে কোনো নারীই নেই, সেখানে এ ধরনের ‘স্ত্রী বাণিজ্য’ বেশ রমরমা।
প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কম থাকায় ওসব এলাকায় পাচার হওয়া নারীদের চুপচাপ ‘নতুন সংসার’ মেনে না নিয়েও উপায় থাকে না। সংঘবদ্ধ চক্র আবার এক প্রদেশের নারীদের ধরে নিয়ে অন্য প্রদেশে বিক্রি করে দেয়। দুর্গম কোনো গ্রামে শ পাঁচেক ডলারের বিনিময়েই কেনা যায় স্ত্রী! তবে এভাবে যে আদৌ সংসার হয় না, সেটা বুঝতে নারাজ চীনের ব্যাচেলররা। এ কারণে এখন বছরে পাচার হওয়ার নারীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে হাজারের অঙ্ক।
* বাড়ছে ডেটিং বাণিজ্য:
পাত্রী নেই, অথচ পকেটে কাড়ি কাড়ি টাকা। চীনের শহরগুলোতে এমন ধনী এখন উঁকি দিলেই দেখা যায়। তাদের কথা মাথায় রেখে অনেকে আবার চুটিয়ে সেরে নিচ্ছে ডেটিং বাণিজ্য। এই বাণিজ্যে আবার বৈচিত্র্যের অভাব নেই। ‘পেং টাই’ নামের এক ডেটিং এজেন্ট সারাদিন শপিং মলগুলোতে ঘুরে বেড়ান। ২০ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীদের দেখা মাত্রই ঝটপট এগিয়ে যান। কাছে গিয়ে অমায়িক হাসি দিয়ে জানতে চান, ‘আপনি কি সিঙ্গেল? মনের মানুষ খুঁজছেন?’ বেশিরভাগই দেখা গেল ভ্রূ কুঁচকে দ্রুত একসিলারেটরের দিকে পা বাড়ান। কেউ আবার হাসিমুখে মাথা ঝাঁকিয়ে চলে যান। আর কেউ যদি একবার উপর নিচ মাথা ঝাঁকান, ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়া আর কাকে বলে! সঙ্গে সঙ্গে এজেন্সিতে নাম লেখানো সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটির সঙ্গে মেয়েটার পরিচয় করিয়ে দেয় ওই এজেন্সি।
পারষ্পরিক মিলমিশ না হলেই আছেন আরো ভুরি ভুরি পাণিপ্রার্থী। আর ডেটিং থেকে একটি সফল বিয়ে হওয়া মানেই এজেন্সির পকেটে লাখ টাকা। বেইজিংয়ের ডায়মন্ড ব্যাচেলর্স এজেন্সির হয়ে কাজ করেন পেং টাই। তার এজেন্সিতে কেবল সদস্য হতেই বছরে ফি গুণতে হয় ১৫ হাজার পাউন্ড থেকে ১০ লাখ পাউন্ড পর্যন্ত! টাকার পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে কতটা মরিয়া হয়ে পাত্রী খুঁজে দেবে এজেন্সির কর্মীরা। আর মনমতো পাত্রীর সন্ধান যে এনে দিতে পারবে সেই এজেন্টের জন্য মোটা অংকের বখশিশ তো আছেই। ক্লায়েন্ট বুঝে যা কয়েক হাজার পাউন্ডও হতে পারে। অর্থাৎ চীনের এই পাত্রী সঙ্কট কারো কারো জন্য আশির্বাদও!
তবে আর যাই হোক, মানুষ এই পৃথিবীর সেরা প্রাণী। তাই বিশ্বায়নের এই যুগে এমন কোন পরিবার পরিকল্পনা করা উচিত নয়, যাতে চীনাদের মত সমস্যায় পড়তে হয়। আর একটি মানুষ বিয়ে কিংবা জীবনসঙ্গী ছাড়া কখনোই পরিপূর্ণ হতে পারেনা।
এইচ এন