২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের ২০টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের জোট জি-২০-র সভাপতির দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে ভারত। বিশ্বমঞ্চে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করবে।
ইন্দোনেশিয়ার বালিতে এবারের জি-২০ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় সম্প্রতি। সেই সম্মেলনে বিশ্ব অর্থনীতি ও বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের ওপর ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ছিল আলোচনার অন্যতম বিষয়। পশ্চিমাদের প্রত্যাশা ছিল, জি-২০ সম্মেলন থেকে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর বিবৃতি আসবে। কিন্তু ভারত ও চীন সম্মত না হওয়ায় বিবৃতিতে সরাসরি রাশিয়ার নিন্দা জানানো হয়নি। তবে জি-২০ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন, ‘আগামী বছর জি-২০ নেতারা যখন বুদ্ধ ও গান্ধীজির দেশে (ভারত) মিলিত হবেন, আমি নিশ্চিত, তখন আমরা সবাই বিশ্ববাসীকে শান্তির বার্তা দিতে পারবো’।
চলতি সপ্তাহে, আমেরিকার উপ-জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন ফিনার আমেরিকার অংশীদারদের তালিকায় ভারতকে ‘খুব উচ্চ’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এটি ‘সত্যিই বৈশ্বিক এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করতে পারে’।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও তার ভারতীয় জনতা পার্টির সমর্থকরা প্রায়শই ভারতের ক্রমবর্ধমান মর্যাদাকে আরও দৃঢ় করতে বৈদেশিক নীতির অ্যাপ্রোচ ঠিক করেছেন। মোদী একজন ক্যারিশম্যাটিক জাতীয়তাবাদী নেতা যিনি নিজেকে ‘বিশ্বে গুরুর’ আসনে বসাতে চান এবং সেই পরিবর্তনের প্রতীক বলে মনে করেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনের বিষয়ে এক বক্তৃতায় বলেছেন, ভারতের ক্ষেত্রে, জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিসরের দিকে পরিচালিত করেছে।
মোদীর জাতীয়তাবাদী বক্তব্যকে একপাশে রেখে, বিদেশনীতির ব্যাপারে মোদী সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্দেশ্য তার পূর্বসূরিদের মতোই উল্লেখযোগ্যভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। কেননা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারত প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে। এটা ভারতের বিদেশ নীতিরই একটি অংশ। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু থেকে নরেন্দ্র মোদীর সময় পর্যন্ত ভারত কোনও যুদ্ধেই সরসরি অংশগ্রহণ করেনি।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভের পর থেকে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে ছিল অর্থনীতির উন্নয়ন, এই অঞ্চলের সুরক্ষা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রতি উচ্চ মনোভাব ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। এসব বিষয় আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং দেশের আধিপত্যের গভীরতাকে উদ্বেলিত করেছে। এই অনুভূতিই ভারত ও অন্যান্য সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে দুটি স্নায়ুযুদ্ধ এড়িয়ে তাদের স্বার্থ অনুসরণ করতে চালিত করেছিল, যা জোট নিরপেক্ষতা হিসাবে পরিচিত। জওহরলাল নেহেরু, যিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন ‘আমরা অন্যদের খেলার জিনিস হতে চাই না’।
আমেরিকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যেটি ৯০ এর দশক থেকে ভারতকে চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাব্য পাল্টা সম্পর্ক হিসেবে দেখা হয়। প্রায়ই বলা হয়, তারা জোট নিরপেক্ষতার পথ মসৃণ করেছে। ২০১৩ সালে ভারতীয় কর্মকর্তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কৌশলগত বিদেশনীতি গ্রহণ করে। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদী, ১৯৭৯ সালের পর প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি ১২০-দেশের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেননি। ১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে প্রতিষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহেরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। জওহর লাল নেহেরুর আর্ন্তজাতিক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল এই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন।
এই অঞ্চলে ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা প্রসারিত করেছে এবং আমেরিকানদের আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চার গণতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া মিলে ‘কোয়াড’ নামে একটি সংলাপের সূচনা করে, যা কার্যত সামরিক জোট হিসেবে পরিচিত। এটি একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক নেটওয়ার্ক। ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনের আধিপত্য কমাতে এই কোয়াড বলে ধরা হয়। এর ফলে মোদী আমেরিকা ও ভারতকে ‘প্রকৃত মিত্র’ হিসাবে বর্ণনাও করেন।
তবুও মোদী সরকারের আমেরিকা অপছন্দ করে এমন সব ধরণের নীতি বজায় রাখা বন্ধ করেনি। বিশেষ করে কয়েক দশক ধরে ভারতের বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের সমালোচনা করার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাবে ভারত ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকার পর বিষয়টি সামনে এসেছে। এরপর সাশ্রয়ে রাশিয়ার তেল ও সার কিনে মজুত করে রেখেছে ভারত।
কিছু ভারতীয় বিশ্লেষক বলেছেন, মোদী জোট নিরপেক্ষতাকে পুনরায় গ্রহণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রী কোভিড -১৯ মহামারির সময়ে আবার জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পথে হেঁটেছেন। সম্ভাব্য কারণ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আমেরিকার ব্যর্থতা, যার মধ্যে ভারতে কোভিড -১৯ ছড়িয়ে পড়ার সময় ভ্যাকসিনের ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার অনিচ্ছাসহ বেশ কিছু কারণ আমেরিকাপন্থিতার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করেছে।
বাস্তবতা হলো, ভারত কখনই এক নীতিতে অটল থাকেনি। ১৯৬২ সালে চীনের সঙ্গে সীমান্ত যুদ্ধের সময় এটি অস্ত্রের জন্য আমেরিকার দিকে ঝুঁকেছিল। আমেরিকা পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে এতদূর ঝুঁকেছে, যার প্রতি নেহেরুভিয়ান অভিজাতরা অনুরাগী ছিলেন। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তখনকার সোভিয়েত সম্পর্কের তুলনায় এখনও স্পষ্টতই শক্ত নয়।
আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সত্যিই সোভিয়েতদের সঙ্গে তার সম্পর্কের চেয়ে বেশি সুবিধাবাদী হতে পারে, কিছু ভারতপন্থি আমেরিকান নীতিনির্ধারকদের ধারণার বিপরীতে এটি। ২০১৯ সালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিজয় গোখলে বলেছিলেন ইস্যুগুলোর ওপর ভিত্তি করে ভারত আজ একটি ‘জোটবদ্ধ’ রাষ্ট্র।
আমেরিকার সঙ্গে এর সহাবস্থান ‘আদর্শগত নয়। এটি আমাদের ক্ষমতা দেয়, আমাদের সিদ্ধান্তমূলক স্বায়ত্তশাসন বজায় রাখার’ এই বিষয়টিকে তুলে ধরে, জয়শঙ্কর বলেন, আমেরিকার ম্লান আধিপত্য, যার মধ্যে চীনের উত্থান ও ভারতের কাছে আগ্রহের প্রসার নিয়ে তার উদ্বেগ লক্ষণীয়। তিনি আরও বলেন, ভারতকে বিভিন্ন এজেন্ডায় একাধিক অংশীদারের সঙ্গে কাজ করার পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
মোদীর অধীনে দেশটি জোরালোভাবে জোট নিরপেক্ষতা অনুসরণ করেছে। তবে তা সত্ত্বেও বাস্তবতা ও দায়বদ্ধতা সতর্কতার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা দেশটির সোভিয়েতপন্থি মনোভাবকে একপাশে রেখে সর্বদা ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিকে নির্দেশিত করেছে।
কিন্তু যদি দেশটির নীতিমালা বিজ্ঞাপনের চেয়ে কম পরিবর্তিত হয় তবে বিশ্ব কীভাবে এটি গ্রহণ করবে তা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ভারতের বর্ধিত সম্পদ ও সক্ষমতার অর্থ হলো একাধিক অংশীদার এটির সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। এটি মোদীকে রাষ্ট্রনায়কের মতো, এমনকি ‘গুরুর’ মতো ভাবতে সাহায্য করে। আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও ভারতকে অস্ত্র বিক্রি করার জন্য রাশিয়ার আগ্রহের বিষয়ে দেশটির মনোভাব পুরোনো। ইউক্রেনের যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিমাদের সতর্ক প্রতিক্রিয়ায় এটি আরও স্পষ্ট হয়েছে।
যুদ্ধের শুরুর দিকে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ‘আমরা জানি রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের একটি সম্পর্ক আছে যা রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থেকে আলাদা। ভারতের সমালোচনা করতে এই আমেরিকান অনীহা মোদীকে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার এবং সামান্য নিন্দা জানিয়ে প্রশংসা অর্জনের উভয় সুযোগ দিয়েছিল। তবে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের ভাষণে নরেন্দ্র মোদী পুতিনের নিন্দা করার পরিবর্তে বলেন, ‘ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির উপায় সবাইকেই খুঁজতে হবে। সেই দায়িত্ব আজ আমাদের প্রত্যেকের ওপরই’। মোদী আরও বলেন, ‘এটা যুদ্ধের সময় নয়’।
গত দুই দশক ধরে ভারতীয় কূটনীতিতে পরিবর্তন হয়েছে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আরও বদলেছে।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট