নেপালের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ স্বার্থগত দ্বন্দ্ব

0

রোববার (১৫ জানুয়ারি) নেপালের পোখরায় ইয়েতি এয়ারলাইন্সের যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়েছে। এতে উড়োজাহাজের ৬৮ আরোহী প্রাণ হারিয়েছেন। হতাহতের দিক থেকে গত তিন দশকে এটি নেপালে সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনাগুলোর একটি।

অ্যাভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, রোববারের দুর্ঘটনাটি নেপালের ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। ১৯৯২ সালের জুলাই এবং সেপ্টেম্বরে ঘটা দু’টি দুর্ঘটনায় কেবল এর চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। ওই বছরের জুলাইয়ে থাই এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন ১১৩ জন। সেপ্টেম্বরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে মারা যান ১৬৭ জন।

নেপালের ভৌগলিক অবস্থান, আবহাওয়া, দুর্বল রক্ষণাবেক্ষণ, অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং শিথিল মানদণ্ডের কারণে উড়োজাহাজ পরিবহন খাত দুর্ঘটনায় জর্জরিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। উড়োজাহাজ চালানোর জন্য নেপালকে সবচেয়ে জটিল অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া নেপালে বিমানবন্দরগুলোর অবস্থানও দুর্ঘটনার একটি কারণ। দেশটিতে বেশ কয়েকটি বিমানবন্দর পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে।

উড়োজাহাজ পরিবহন ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নেপালে আবহাওয়ার সঠিক তথ্য পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। বিশেষ করে পাহাড়ি ভূখণ্ডে এই অভাব প্রকট। এসব এলাকায় বেশিরভাগ দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। পাহাড়ি এলাকায় আবহাওয়া খুব দ্রুত পরিবর্তনশীল। এতে উড়ন্ত উড়োজাহাজের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বেগ পেতে হয় পাইলটদের। ভৌগলিক ও প্রযুক্তিগত কারণের পাশাপাশি নেপালে দায়হীন ব্যবস্থাপনার জন্য অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ দায়ী। স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে গড়ে উঠছে না সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।

১০ বছর নেপালে বড় দুর্ঘটনা

গত ১০ বছরে নেপালে বেশ কয়েকটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০১২ সালের ১৪ মে ইয়েতি এয়ারলাইন্সের ডিএইচসি-৬ দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট একটি উড়োজাহাজ নেপালের জমসম নামক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। উড়োজাহাজটির তিন ক্রুসহ ১৯ জন যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান।

একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর অগ্নি দরনিয়ের ডিও ২২৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজ নেপালের মাইগদি জেলায় বিধ্বস্ত হয়। তিন ক্রুসহ ২১ জন যাত্রীর সবাই এতে মারা যান।

২০১৪ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিতা এয়ার দরনিয়ের ডিও ২২৮ মডেলের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। ওই উড়োজাহাজের তিন যাত্রী ক্রুসহ ২১ যাত্রীর সবাই প্রাণ হারান।

২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের একটি এয়ারলাইন্সের একটি কার্গো বোয়িং ৭৪৭-৪০০এফ নেপালের জগবুদ্ধ নামক গ্রামে বিধ্বস্ত হয়। কার্গো উড়োজাহাজটির চার ক্রুর সবাই নিহত হন।

২০১৮ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বোম্বারডিয়ার ড্যাশ ৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়। এতে ৫১ জন নিহত ও ২০ জন আহত হন।

২০০০ সালের পর নেপালে এ পর্যন্ত ১৭টি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৭৩ জন। ২০১০ সালের পর এ পর্যন্ত দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১টি।

২০২২ সালের মে মাসে তারা এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ মুস্তাংগ নামক এলাকায় বিধ্বস্ত হয়। এতে উড়োজাহাজের ২২ জন যাত্রী প্রাণ হারান।

দুর্ঘটনার বড় কারণ ভৌগোলিক

নেপালে উড়োজাহাজ চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার একটি বড় কারণ হলো ওই অঞ্চলের ভূ-সংস্থান। এভারেস্টসহ বিশ্বের ১৪টি সর্বোচ্চ পর্বতের মধ্যে আটটি নেপালে। এসব সুউচ্চ পর্বত এবং কুয়াশাপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নেপালে উড়োজাহাজ চালানো বিপজ্জনক।

বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের পাইলট ক্যাপ্টেন এবং সেফটি ম্যাটারস ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা অমিত সিং বার্তাসংস্থা এএনআই’কে বলেন, নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু একটি উপত্যকা। এই শহরে বিমানবন্দরটি একটি বাটির মতো। চারদিকে উঁচু পাহাড়। তাই এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি বিমানবন্দর।

দেশটির বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ ২০১৯ সালের একটি নিরাপত্তা প্রতিবেদনে বলেছিল, দেশের আবহাওয়া এবং ভূ-সংস্থানগত বৈচিত্র্যের কারণে ছোট উড়োজাহাজগুলো দুর্ঘটনায় পড়ে।

নেপালে বেশ কয়েকটি হার্ড-টু-অ্যাক্সেস বিমানবন্দর রয়েছে। যেমন, নেপালের লুকলা এলাকার তেনজিং-হিলারি বিমানবন্দরটি বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক বিমানবন্দর হিসেবে পরিচিত।

পুরনো প্রযুক্তি এবং অপ্রতুল প্রশিক্ষণ

নেপালের অ্যাভিয়েশন শিল্প গত কয়েক বছর ধরে বিকশিত হচ্ছে। দেশটিতে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কার্যক্রম ব্যাপক বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হচ্ছে না। বিদ্যমান অবকাঠামোর পরিচর্যা, প্রযুক্তির আধুনিকায়ন খুবই অপ্রতুল।

নেপাল বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য পুরানো উড়োজাহাজের উপর নির্ভর করে দেশটি। এই বিমানগুলোর বেশিরভাগেরই প্রয়োজনীয় আধুনিক সরঞ্জাম যেমন রাডার এবং জিপিএস প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণ নেই।

উদাহরণস্বরূপ, ইয়েতি এয়ারলাইন্স দুই দশক আগে উড়োজাহাজ পরিচালনা শুরু করলেও তাদের বহরে আছে শুধু এটিআর ৭২-৫০০ এস মডেলের উড়োজাহাজ। ফ্লাইট ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪ এর দেওয়া তথ্যমতে, রোববার দুর্ঘটনায় পড়া উড়োজাহাজটির বয়স ছিল ১৫ বছর।

২০২২ সালের মে মাসে বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটি প্রথম উড্ডয়ন করেছিল ১৯৭৯ সালে। ওই উড়োজাহাজে ছিল না আধুনিক কোনো প্রযুক্তি।

ক্যাপ্টেন বেড উপ্রেতি গত বছর দ্য গার্ডিয়ানকে এসব ব্যাপারে বলেছিলেন, ৪৩ বছর পুরনো উড়োজাহাজ উড়ন্ত রাখার সামর্থ্য আমাদের নেই। প্রযুক্তির অভাব নিয়ে নেপালের মতো জায়গায় উড়োজাহাজ চালানো বিপজ্জনক।

নেপালের অ্যাভিয়েশন সেক্টরের এমনই অবস্থা যে, নিরাপত্তার কারণে নেপালের সমস্ত এয়ারলাইন ক্যারিয়ার ২০১৩ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে নিষিদ্ধ।

সমস্যা উড়োজাহাজ সংস্থা নিজেও

আবহাওয়া, প্রতিকূল ভৌগোলিক অবস্থা ও সেকেলে প্রযুক্তির পাশাপাশি আরেকটি সমস্যায় জর্জরিত নেপালের উড়োজাহাজ খাত। সমস্যাটি হলো সেদেশের উড়োজাহাজ সংস্থা নিজেই।

নেপালের বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ (সিএএএন) দেশটিতে একইসঙ্গে পরিষেবা প্রদানকারী এবং নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান। এর ফলে যখন নিরাপত্তা বা বিভিন্ন প্রবিধান মানার প্রশ্ন উঠে তখন জন্ম নেয় স্বার্থগত দ্বন্দ্ব।

ইউরোপীয় কমিশন এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল সংস্থা (আইসিএও) ২০০৯ সাল থেকে নেপালকে বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ ভেঙে দেওয়ার অনুরোধ করে আসছে। আইসিএও মনে করে, নেপালের সিএএএন একইসঙ্গে দুই দায়িত্ব পালন করায় কোনোটিই যথাযথভাবে হচ্ছে না।

কাঠমান্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপালের বেসামরিক উড়োজাহাজ চলাচল কর্তৃপক্ষ দুই ভাগ করার বিরুদ্ধে সেদেশে একটি রাজনীতি রয়েছে। সংস্থাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই সংবাদপত্রটিকে বলেছেন, সিভিল অ্যাভিয়েশন সংস্থাটি আলাদা হয়ে গেলে কিছু শীর্ষ পদধারী যে দ্বৈত সুবিধা পেয়ে আসছেন তা হারাবেন।

পত্রিকাটি আরও বলেছে, পর্যটন প্রতিমন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতারা সংস্কার ও পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছেন, কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি।

অ্যাভিয়েশন বিশ্লেষক হেমন্ত আরজ্যাল এ ব্যাপারে বলেন, সমস্যাটি আমাদের সিস্টেমে। দেশের কথা কেউ চিন্তা করে না। প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার করার সময় রাজনীতিবিদরা বুদ্ধিমান। কিন্তু এই কাজটি (সিএএএন দুই ভাগ) আমাদের করা উচিত। শুধু প্রতিশ্রুতি কাজে আসবে না।

সারাবাংলা

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More