সৌরভ গাঙ্গুলি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বা বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট পদে আর থাকছেন না। বিষয়টা স্পষ্ট হতেই সেই সিদ্ধান্তকে ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক।পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা দাবি তুলেছেন, বিজেপিতে যোগদান না করার জন্যই সৌরভকে বোর্ড প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো কি না, ওই দলটিকে তার জবাব দিতে হবে।বিজেপির পক্ষ থেকে অবশ্য দাবি করা হচ্ছে, বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত।তবে ভারতের ক্রিকেট প্রশাসনকে যারা বহু দিন ধরে জানেন তারা অনেকেই বলেন ক্রিকেট বোর্ডের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক আছে। আর সৌরভ গাঙ্গুলিও সব জেনে বুঝেই তাতে জড়িয়ে পড়েন।বস্তুত প্রায় তিন বছর বোর্ড প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর সৌরভ গাঙ্গুলি যে আর ওই পদে থাকছেন না, ইতোমধ্যেই তা স্পষ্ট হয়ে গেছে বোর্ডের ভাইস-প্রেসিডেন্ট রাজীব শুক্লার কথাতে।শুক্লা জানান, আগামী ১৮ অক্টোবরের নির্বাচনে সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা পড়েছে মাত্র একটি। আর সেটি হলো সাবেক অলরাউন্ডার রজার বিনির। ফলে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাতেই নির্বাচিত হবেন ।বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও ধনী এই ক্রিকেট বোর্ডের সচিব পদেও থেকে যাবেন জেয় শাহ। যিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে।এর পরই তৃণমূল কংগ্রেসের সিনিয়র এমপি শান্তনু সেন দাদার পাশে থাকার বার্তা দিয়ে টুইট করে বলেন, সৌরভ গাঙ্গুলি বিজেপিতে যোগ দেননি বলেই কি তার ওপর এই কোপ পড়ল?সৌরভ গাঙ্গুলিকে সরে দাঁড়াতে হলেও অমিত শাহের ছেলে কীভাবে বোর্ডের পদে রয়ে গেলেন। সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।সৌরভ গাঙ্গুলি যেকোনো সময় বিজেপিতে যোগ দেবেন। লাগাতার এই প্রচার করে যাওয়ার পর এখন কেন তাকে সরানো হল। সেই প্রশ্ন তুলেন কলকাতায় তৃণমূল নেতা কুনাল ঘোষও।তিনি বলেন, ‘একটা সময় তারা এই প্রচারের জোয়ার বইয়ে দেন। এখন প্রচারের ভাঁটার সময়েও উত্তর তো তাদেরই দিতে হবে।’কুনাল ঘোষ বলেন, ‘বিজেপিতে যোগ দিলেন না বলেই কি সৌরভকে আর রাখা হল না? অথচ বিজেপি নেতার ছেলে দিব্বি নিজের পদে রয়ে গেলেন। এটা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ আর জল্পনা যে তৈরি হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’তৃণমূল এ বিষয়ে সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও বিজেপির কাছে যে কৈফিয়ত দাবি করছে সেটাও খোলাখুলি জানান দলের এই নেতা।পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেত্রী ও সংসদ সদস্য অগ্নিমিত্রা পাল আবার পাল্টা বলেন, রাজ্যের ক্রীড়া প্রশাসনে তৃণমূল যেভাবে দলীয় লোকজন ঢুকিয়েছে তাদের মুখে এসব কথা মানায় না।তিনি বলেন, ‘খেলাধুলা থেকে শিক্ষা, যারা রাজ্যের সব কিছুতে রাজনীতি ঢোকায় তাদের কাছ থেকে অন্য কী আর আশা করা যায়? দিদিমণির দাদা, ভাই, বোন, ভাগ্নে, ভাইজিদেরই এ রাজ্যে ক্রিকেট থেকে ফুটবল, লুডো থেকে বাগাডুলি সব খেলার ফেডারেশনের মাথায় বসানো হয়েছে।’তবে ঘটনা হলো ভারতের ক্রিকেট বোর্ডেও নতুন কমিটির বহু সদস্যই বিজেপির প্রভাবশালী নেতা। গত মাসে অল ইন্ডিয়া ফুটবল ফেডারেশনেও নতুন সভাপতি হয়েছেন কল্যাণ চৌবে। তিনিও বিজেপির নেতা।বিজেপিও তো ক্রিকেট বা ফুটবল সব ক্ষেত্রে ঠিক একই জিনিস করছে? এমন প্রশ্নের জবাবে অগ্নিমিত্রা পাল বলেন, ‘দু’টাকে কীভাবে মেশানো সম্ভব? সৌরভ গাঙ্গুলির সরে যাওয়াটা একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। মেয়াদ শেষ হলে তার জায়গায় অন্য কেউ আসবেন, এই তো ব্যাপার। ভারতীয় বোর্ডে পর পর দু’মেয়াদে কারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার নজির নেই। কেউ কেউ একাধিকবার প্রেসিডেন্ট হলেও তার মাঝে কয়েক বছরের ব্যবধান ছিল।’অগ্নিমিত্রা আরো বলেন, ‘আর জেয় শাহকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এটা তো দেখছেন না যে রাজীব শুক্লা ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়ে যাচ্ছেন। তিনি তো কংগ্রেস করেন।’বিজেপি এই নেত্রী আরো দাবি করেন, সৌরভ গাঙ্গুলির সাথে অমিত শাহ কিংবা মমতা ব্যানার্জি এমন কী সিপিআইএম নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বা অশোক ভট্টাচার্যরও যেহেতু ব্যক্তিগত পর্যায়ে খুব ভাল সম্পর্ক। তাই ক্রিকেট বোর্ডে তার ভূমিকাকে রাজনীতির প্রিজম দিয়ে দেখা উচিত নয়।তিন বছর আগে বোর্ড সভাপতির পদে সৌরভ গাঙ্গুলির নিয়োগে রাজনীতির কতটা ভূমিকা ছিল তা নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর।সেবার কর্নাটকের ক্রিকেটার ব্রিজেশ প্যাটেলের প্রেসিডেন্ট হওয়া একরকম চূড়ান্ত হয়ে গেলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে নাটকীয়ভাবে সেই পদ ছিনিয়ে নেন সৌরভ গাঙ্গুলি। তার টিমে সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন জেয় শাহ।পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েই তিনি বোর্ড প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। ভারতের প্রায় সব প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমেই তখন এ ধরনের লেখালেখি হয়েছিল।বোর্ডের বহু পদে দীর্ঘ দিন ধরে দায়িত্ব সামলেছেন ক্রিকেট কর্মকর্তা বিশ্বরূপ দে।
তিনি বলেন, বিগত প্রায় তিন দশক ধরে রাজনীতিই কিন্তু ভারতের ক্রিকেট বোর্ডকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে।বিশ্বরূপ দের মতে, ‘আগেও অল্পস্বল্প হয়তো ছিল। কিন্তু শারদ পাওয়ার যখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট হন তখন থেকেই আসলে বোর্ডের একশোভাগ নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। পাওয়ারের সাথে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্কই ছিল না। কিন্তু তাকে প্রেসিডেন্ট বানাতে উঠেপড়ে লাগে এই বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম সব দল।’বিশ্বরূপ আরো বলেন, ‘আজ সিপিএম বড় বড় কথা বলে, তাদের সর্বোচ্চ নেতারাও কিন্তু সেদিন নিজেদের ত্রিপুরার ভোট শারদ পাওয়ারকে দিতে পণ করেছিলেন। সোনিয়া গান্ধী বলেছিলেন কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত সব রাজ্যের ভোট যেন পাওয়ারই পান।’তখন থেকেই ভারতীয় বোর্ডে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের এই ট্র্যাডিশন চলেছে এবং কেন্দ্রে যে দল যখন ক্ষমতায় থেকেছে তাদের নমিনিরাই বোর্ডে ছড়ি ঘুরিয়েছে।ফলে এখন বোর্ড থেকে সৌরভ গাঙ্গুলির বিদায়কেও রাজনীতির ওঠাপড়ার অংশ হিসেবেই দেখতে চান বিশ্বরূপ দে।
তিনি যখন সিএবির (ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল) সভাপতি হন, তখনও কিন্তু জগমোহন ডালমিয়ার মৃত্যুর ৭২ ঘন্টার মধ্যে নবান্নতে গিয়ে মমতা ব্যানার্জিকে রাজি করিয়ে ফেলেন। সেটাও তো রাজনীতিই ছিল, তাই না?বিশ্বরূপ দে বলেন, ‘নবান্ন থেকে সিএবি প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা হচ্ছে। এ জিনিস তো আগে কখনো হয়নি। নরেন্দ্র মোদি যদি বিসিসিআই সভাপতির নাম ঘোষণা করেন তাহলে যা হবে এটাও তাই।’অতএব সৌরভ গাঙ্গুলিকে তিনি রাজনীতির ভিক্টিম বা শিকার বলে মানতে রাজি নন।বর্ষীয়ান ওই ক্রিকেট কর্মকর্তা বলেন, ‘তিনি জেনে বুঝেই রাজনীতি করেছেন। আর কে না জানে রাজনীতিতে গোলাপও থাকে, কাঁটাও থাকে। আগে দু’দু’বার গোলাপের মালা পরলেও এবারে তাকে কাঁটার খোঁচা খেতে হলো। আমি বিষয়টাকে সেভাবেই দেখি।’গোটা বিতর্ক নিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলি নিজে এখনো কোনো মন্তব্য করেননি। সোশ্যাল মিডিয়াতেও কিছু লেখেননি।তবে তার ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পদের বদলে তাকে আইপিএল চেয়ারম্যান হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। যা তিনি ফিরিয়ে দেন।সূত্র : বিবিসি