বিড়ম্বনার চার অধ্যায় বিজেপির গলায় এ বার তৃণমূলের লকেট

0
বিজেপিতে যোগ দিলেন অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
বিজেপিতে যোগ দিলেন অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।

তৃণমূলের   গলা থেকে বিশিষ্ট ‘লকেট’ ছিনিয়ে নিল বিজেপি!

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ অভিনেত্রী এবং রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্যা লকেট চট্টোপাধ্যায় বৃহস্পতিবার তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিলেন। জর্জ বেকার, নিমু ভৌমিক, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, অঞ্জনা বসু, দেবিকা মুখোপাধ্যায়-সহ টলি এবং টেলিউডের এক ঝাঁক তারকা সাম্প্রতিক কালে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। তবে তাঁরা কেউই প্রকাশ্যে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ছিলেন না। এই প্রথম সরাসরি তৃণমূলের কোনও ‘তারকা’ রতন-হার বিজেপি-র গলায় উঠল!

লকেট জানিয়েছেন, তিনি মানুষের জন্য কাজ করার আশায় তৃণমূলে গিয়েছিলেন। কিন্তু তা করতে পারেননি। উল্টে তৃণমূলে তাঁর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছিল! দলের কাজকর্মের সঙ্গে নিজের নীতি-আদর্শের সংঘাত হচ্ছিল। তাই তিনি তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিলেন। লকেটের কথায়, “দলের মধ্যে থেকে প্রতিবাদ তো করতে পারলাম না! মনে হল, বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করাটাই সহজ।” তাঁর উপলব্ধি, সারদা কাণ্ড থেকে শুরু করে নারী নির্যাতন, অরূপ ভাণ্ডারীর মতো প্রতিবাদীদের মৃত্যু সমস্ত ঘটনা থেকেই বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূল সরকার জনবিচ্ছিন্ন। লকেটের বক্তব্য, “যেখানেই যাই, সারদা কাণ্ড নিয়ে কথা শুনতে হয়। তৃণমূলের ভিতরে অবিশ্বাস জন্মে গেছে। সকলেই সকলকে দুর্নীতির ভাগীদার বলে সন্দেহ করছে। আমরা খেটে খাই! এটা আমাদের ভাল লাগছে না।”

লকেট জানান, তিনি একটা উন্মুক্ত আকাশ খুঁজছিলেন। বিজেপি-র অজস্র কর্মকাণ্ড দেখে বুঝতে পেরেছেন, এটাই তাঁর জায়গা। লকেটের কথায়, “কোনও স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিজেপি-তে যোগ দিইনি। অভিনয়ের বাইরে আমি মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছি। বিজেপি-তে সেই কাজ করা যায়। নরেন্দ্র মোদী তাঁর কাজের মাধ্যমে সকলকে আকর্ষণ করছেন।” অভিনেত্রীর ক্ষোভ, “আমি রাজ্য সরকারের কাছ থেকে কোনও পুরস্কার পাইনি। পুরস্কারের প্রতি আমার কোনও লোভও নেই! জনগণের ভালবাসা অনেক মূল্যবান।”

শাসক দলের পাশাপাশি রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্যপদও ছেড়েছেন লকেট। তাঁর ব্যাখ্যা, “বিবেকে বেধেছে বলেই ওই পদ ছেড়েছি। দল আমাকে পুরস্কার বা স্বীকৃতি হিসাবে মহিলা কমিশনের পদ দিয়েছিল। দলেই যখন থাকছি না, তখন সেই উপহার   আঁকড়ে থাকার মানে হয় না!” তাঁর আরও অভিযোগ, মহিলা কমিশনে কাজের পরিবেশ নেই। সেখানে দলতন্ত্র চলছে। নেতা-মন্ত্রীরা মহিলা কমিশনের সিদ্ধান্তের উপরে চাপ তৈরি করছেন। ফলে, সেখানে কাজ করতে গিয়ে তাঁকে দলের থেকে অনেক বাধা পেতে হয়েছে।

বস্তুত,  লকেট বা জুন মালিয়ার মতো বিশিষ্টকে মহিলা কমিশনে প্রতিনিধি হিসাবে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী পাঠিয়েছিলেন সমাজের বৃহত্তর অংশে তাঁদের পরিচিতি এবং প্রতিষ্ঠার সুবাদেই। নিছক তৃণমূল সদস্যা হিসাবে নয়। কার্যক্ষেত্রে ওই ধরনের কমিশনে গিয়ে একেবারে শাসকের তাঁবেদারি লকেটরা করতে পারেননি! ইতিপূর্বেই তার ইঙ্গিতও মিলেছে। ফলে,  কমিশনে লকেটদের পাঠিয়ে তৃণমূলের বিশেষ ফায়দা হয়নি। অনেকেরই আশঙ্কা, এর পরে বেশি বশংবদ কাউকে পাঠিয়ে মহিলা কমিশনকে আরও ঠুঁটো করে দেওয়ার চেষ্টা হবে! ঠিক যেমন হয়েছে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের! প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের বিদায়ের পরে রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে দায়িত্বে বসিয়ে মানবাধিকার ‘স্বাধীন’ সত্তাকে কার্যত বিসর্জনই দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক বার সরব হয়েছে বিরোধীরা। মহিলা কমিশনের ক্ষেত্রেও একই জিনিসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে বলে তাদের আশঙ্কা।

লকেট-জুনের মতো বিশিষ্টেরা মহিলা কমিশনে গিয়ে যে সব ক্ষেত্রে শাসকের সুরেই সুর মেলাননি, তার ইঙ্গিত ধরা পড়েছিল যাদবপুর-কাণ্ডের সময়েই। যাদবপুরে পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করে অভিনেত্রী জুন বলেছিলেন, “কমিশন কোনও পদক্ষেপ করবে কি না, তা নিয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে বলতে পারি, আমি টিভিতে যে ঘটনা দেখেছি, তা কিছুতেই সমর্থন করা যায় না। সেখানে স্পষ্ট দেখা গিয়েছে, শুধু ছাত্ররা নন, ছাত্রীরাও নিগৃহীতা হয়েছেন।” যাদবপুর-কাণ্ডে পুলিশের আচরণের প্রতিবাদ করেছিলেন লকেটও। তাঁর সিদ্ধান্ত জানার পরে এ দিন জুন বলেন, “লকেট ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছিলেন। এখন নিজের সিদ্ধান্তেই আবার বিজেপি-তে গেলেন। গণতান্ত্রিক দেশে ওঁর এই ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে আমাদের কী প্রতিক্রিয়া দেওয়ার থাকতে পারে!” জুন আরও জানান, এক-দেড় মাস আগে মহিলা কমিশনের বৈঠকেও লকেট গিয়েছিলেন। তবে কেন তিনি কমিশন ছাড়লেন, তা জুন জানেন না।

অনতি অতীতে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের মতো তৃণমূল নেতা মন্ত্রিত্ব ছেড়ে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু সেটা ছিল একেবারে রাজনৈতিক পরিসরে দল-বদল। লকেটের মতো বিশিষ্টদেরও দল বদলাতে দেখে প্রধান বিরোধী দল সিপিএম মন্তব্য করেছে, সব ক্ষেত্রেই একেবারে মমতার জুতোয় পা গলাচ্ছে বিজেপি! বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের কটাক্ষ, “যে ভাবে লকেট ছিনতাই হচ্ছে, যে ভাবে ফেব্রুয়ারি মাসেই জুনের আবির্ভাবের কথা বাতাসে ভাসছে, তাতে সর্বত্রই এই প্রশ্ন উঠছে!” শিবির ছেড়ে গেলে যে কোনও রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বই যা করেন, সেই ভাবেই তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বোঝাতে চেয়েছেন, লকেটের চলে যাওয়ায় তাঁদের দলের কোনও ক্ষতি হবে না। তাঁর দাবি, দলের একনিষ্ঠ এবং সক্রিয় কোনও কর্মী তৃণমূল ছাড়েননি। পার্থবাবুর কথায়, “এ সব নিয়ে যত কম বলা যায়, ততই ভাল! চিত্রাভিনেতা বিশিষ্ট জনেরা কেন দলে আসছেন, কেনই বা যাচ্ছেন, তার ব্যাখ্যা তাঁরাই দিতে পারেন! লকেট তাঁদের মধ্যে এক জন!” বলা বাহুল্য, লকেট ব্যাখ্যা দিতে পারবেন বলে তৃণমূল নেতৃত্ব এখন মন্তব্য করলেও এঁদের সকলকেই দলে টানায় যাঁর প্রধান ভূমিকা ছিল, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! টলিউড-অভিযানে তাঁর বিশিষ্ট সেনাপতি যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। এই সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠলেই যিনি এ দিন সহাস্যে দাবি করেন, দাঁতের ব্যথার জন্য চিকিৎসক তাঁকে কথা না বলার পরামর্শ দিয়েছেন! তৃণমূল যখন অস্বস্তি ঢাকতে ব্যস্ত, বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ তখন লকেটকে যোগদান করিয়ে বলেছেন, “অভিনেত্রী হিসাবে ওঁর বাজার ভাল। সেই অবস্থায় তিনি এসেছেন। বাজার পড়ে যাওয়ার পরে আসেননি! ওঁর যোগদান বিজেপি-র পক্ষে লাভজনক।” বনগাঁ লোকসভা এবং কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনের প্রচারেও যাবেন লকেট। তাঁর দল বদল তৃণমূলে যাঁরা ‘রুদ্ধশ্বাস’ অবস্থায় টিকে রয়েছেন, তাঁদের বিজেপি-মুখী হওয়ার সাহস জোগাবে বলে আশা করছেন রাহুলবাবু।

লকেট কি এ বার অভিনয় জগতের সহকর্মীদেরও বিজেপি-তে যোগদান করএত আবেদন করবেন? লকেটের জবাব, “আমি আলাদা করে কাউকে আবেদন করব না। আমার যোগদানটাই আমার আবেদন। যাঁরা ভিতরে ভিতরে ভাবছেন, তাঁরা হয়তো আমাকে দেখে উৎসাহ পাবেন।” তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার পর কি তিনি মমতা-ঘনিষ্ঠ থাকেবেন? লকেটের মন্তব্য, “আমি ওঁর কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনও দিনই ছিলাম না যে, আমার চলে যাওয়া নিয়ে ওঁকে ভাবতে হবে। আর আমি তো দল ছেড়ে দূরে চলে এলাম! দূরেই থাকব!” তিনি মমতাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, “উনি ভাল থাকুন! সুস্থ থাকুন!”

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More