সন্তানকে কার কাছে রেখে অফিসে যাব? প্রথমবার মা হওয়ার পর থেকে এ কথাই ভাবছিলেন রেশমি শর্মা। কর্মস্থল থেকে তিনি বেতনসহ তিন মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছিলেন। বিনা বেতনে ছুটি নিয়েছেন আরও দুই মাস। এরপর কী হবে? সে চিন্তায় অস্থির এই মা।
মা হওয়ার পর এই চিন্তায় ভোগে কম-বেশি সবাই। উন্নত-অনুন্নত সব দেশেই মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে একধরনের কার্পণ্য দেখা যায়। মুখে নারীর ক্ষমতায়নের তুবড়ি ছোটালেও, মা তাঁর সন্তানকে কোথায় কীভাবে রেখে যাবেন, তা নিয়ে অনেক দেশই উদাসীন।
বাংলাদেশে সম্প্রতি সরকারিভাবে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয়েছে। ভারতে মাতৃত্বকালীন ছুটি বেতনসহ তিন মাস। তবে দেশটির সরকার এই ছুটি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মাতৃত্বকালীন ছুটির তালিকা দেখলে চোখ কপালে ওঠে। চীনে মাতৃত্বকালীন ছুটি তিন মাসের একটু বেশি, ১৪ সপ্তাহ। আর এ সময় একেবারে অল্প বেতন দেওয়া হয় মায়েদের। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি মাত্র তিন মাস। তাও আবার প্রতিষ্ঠান এ সময় মায়েদের বেতন দিতে বাধ্য থাকে না। মায়েদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভাবে ব্রিটেন। সেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি নয় মাসেরও বেশি। প্রায় ৩৯ সপ্তাহ। প্রথম ছয় সপ্তাহে মায়েদের বেতনের ৯০ শতাংশ দেওয়া হয়।
মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস করার পরিকল্পনা করছে ভারত সরকার। দেশটির পার্লামেন্টে এটি এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। দেশটির নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, সরকার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মাতৃত্বকালীন সুবিধা বাড়াতে আইন অনুমোদন করবে।
রেশমি বলেন, যদি তিনি ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন সুবিধা পান তাহলে সৌভাগ্য বলে মনে করবেন। কারণ নবজাতকের লালনপালনের জন্য তিন মাস খুবই কম সময়। রেশমি শিক্ষকতা করেন।
ভারতের অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বারস অব কমার্সের জরিপ বলছে, সন্তান হওয়ার পর সে দেশের নারীদের এক-চতুর্থাংশ চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়। ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা খুব কম। মোট কর্মজীবীদের মাত্র এক-চতুর্থাংশ নারী। গত ১০ বছরে এই হার ক্রমশ কমছে।
ভারত, বাংলাদেশে নতুন মা হওয়ার পর নারীদের একটি বড় অংশ চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে কর্মস্থলে অসহযোগিতা, সন্তান লালনপালনের কোনো বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয় মায়েদের। এর সঙ্গে রয়েছে সামাজিক কিছু বদ্ধমূল ধারণা। মায়েরা চাকরি করতে গেলে অনেকেই তাদের উচ্চাভিলাষী বলে থাকে। সমালোচনা করে।
উন্নত দেশগুলোতে শিশুদের দিবাযত্নকেন্দ্র রয়েছে। এ দিক দিয়ে আমরা একেবারেই পিছিয়ে। কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে শিশুদের জন্য। কিন্তু শিশুদের এসব দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনার জন্য সরকারি কোনো আইন হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে এসব দিবাযত্নকেন্দ্রে শিশুদের রাখার খরচও অনেক বেশি পড়ে।
তবে এ ক্ষেত্রে ভারত কিছুটা এগিয়েছে। গত দুই তিন বছরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের ক্যাম্পাসে শিশু দিবাযত্নকেন্দ্র খুলেছে। এর মধ্যে রয়েছে গোদরেজ, হিন্দুস্তান ইউনিলিভার ও প্রসাধনী সামগ্রীর প্রতিষ্ঠান লরিয়্যেল। ভারতের শ্রমমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে ৩০ জনের বেশি নারী কর্মী রয়েছেন, তাঁদের কর্মস্থলের ক্যাম্পাসে অথবা কর্মস্থলের কাছে সন্তানদের জন্য একটি দিবাযত্নকেন্দ্র খুলতে হবে।
মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো নিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও কিছুটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। মাতৃত্বকালীন ছুটি বেশি থাকলে কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে—এমন মতও রয়েছে। ভারতে মানবসম্পদবিষয়ক একটি কনসালট্যান্সি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন অনুরাগ শ্রীবাস্তব। তিনি বলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়ার ভয়ে চাকরির সাক্ষাৎকারে নারীকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি বিয়ে করবেন কি না বা তার সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি না।
শ্রীবাস্তব মনে করেন, যদি নারীকে মাতৃত্বকালীন ছুটি বেশি দেওয়া হয় তাহলে কর্মস্থলে তাঁর অবমূল্যায়ন হবে। অনেক সময় নারীকে চাকরি দিতে ভয় পাবে চাকরিদাতারা।