সংসার সুখের হয় বয়স নয়, বোঝাপড়ার গুণে !

0

HAppyস্বামীর বয়স স্ত্রীর চেয়ে অনেকটাই বেশি। এটা কি দুজনের বোঝাপড়ায় খামতি তৈরি করতে পারে? বয়সে ছোট স্ত্রীর সাধ-আহ্লাদের সঙ্গে কি স্বামী তাল মেলাতে পারেন? স্বামী তো স্ত্রীর বেশ আগেই বুড়িয়ে যাবেন, তখন কী হবে? বয়সের ব্যবধান থেকে স্বামী-স্ত্রীর মানসিক-শারীরিক ব্যবধানও কি বাড়তে থাকে?স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান বেশি হলে বিয়ের আগে বা পরে এমন প্রশ্ন নিজেদের মনে যেমন আসে, তেমনি চারপাশের মানুষের মনেও আসে। স্বামীকে ‘আপনে-আজ্ঞে’ বা ‘আমাদের উনি’ বলে সম্বোধন করার যুগ থেকেই তো আমরা এমন অনেক দম্পতিকে দেখছি। তবে পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকলে দাম্পত্যে বয়স কোনো বড় কথা নয়।

বয়সের ব্যবধান অনেক, কিন্তু দাম্পত্য জীবন সুখের-এমন উদাহরণ কম নেই। ডা. রত্না ও ডা. জামিলের বিবাহিত জীবন ২৫ বছর পূর্ণ হতে চলল। দুজনের বয়সের পার্থক্য আট বছর। অভিজ্ঞতার আলোকে রত্না জানান, সুখী দাম্পত্য জীবনের পেছনে বয়সের ফারাক কোনো বাধা নয়; মনের মিল আর পারস্পরিক বোঝাপড়াই আসল। বিয়ের পর স্নাতক ও পরবর্তী সময়ে চাকরি, বিশেষায়িত ডিগ্রি এবং ক্যারিয়ার গড়ে তোলার পেছনে স্বামীর সার্বক্ষণিক সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা তাঁর সঙ্গেই ছিল। এ ক্ষেত্রে বয়সের ব্যবধান কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

রত্না বলেন, আধুনিকতা বা উদারতা-এসব গুণ বয়স দিয়ে বিচার করা যায়
না। যেকোনো বয়সের মানুষই এই গুণের অধিকারী হতে পারে। আর পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ, আস্থা ও ভালোবাসা-এসব হলো সুখী দাম্পত্য জীবনের আসল রহস্য।

সামিয়ার বিয়ে হয়েছিল স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের পরীক্ষার পরই। স্বামী তাঁর চেয়ে পাক্কা ১২ বছরের বড়। সামিয়া মনে করেন, তাঁদের বোঝাপড়ায় কোনো সমস্যা হয়নি। কেননা, তাঁর স্বামী জড়িত ছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। ফলে, দিলখোলা মানুষ। আবার সামিয়া নিজেও পেশাজীবী নারী। দুজনেরই ব্যস্ত জীবন। কিন্তু অফিস শেষে দুজনে বাসায় ফিরে একান্তে কিছুটা সময় ঠিকই পার করতেন। ছুটিছাটায় বাইরে যেতেন।

এই দুই উদাহরণের উল্টোটাও ঘটে। কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত স্বামী হয়তো নিজের কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে বয়সে বেশ ছোট স্ত্রীর প্রতি দায়িত্বটাই বেশি পালন করছেন, পরস্পরকে বোঝার জন্য সময় দিচ্ছেন না। তারপর সন্তান লালন-পালন ইত্যাদি। ধীরে ধীরে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দূরত্ব তৈরি হতে থাকে।

সন্তানও একসময় বড় হয়, কিন্তু তখন স্বামী বার্ধক্যের পথে। তাঁর উদ্যম ততটা নেই, যতটা তখনো স্ত্রীর মধ্যে বিদ্যমান। ঘটনা এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তখন কেউ কাউকে আর সহ্যই করতে পারেন না। দুজনই বলতে থাকেন, ‘তোমার কাছ থেকে আমি তো কিছুই পাইনি।’ সামাজিকতা মেনে হয়তো অনেকেই এক ছাদের নিচে ভালোবাসাহীন সম্পর্ক টেনে বেড়ান, আবার কেউ কেউ সম্পর্কটার ইতি টানেন।

একটা সময়ে মূলত পাত্রের যোগ্যতা বা অবস্থান বিচার করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করতেন মা-বাবারা। পাত্রের বয়স কত, তা বিবেচনাতেই আনা হতো না। সে কারণে আজ থেকে ২০-৩০ বছর বা তারও আগে স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান আট, নয়, কখনো ১০ বা ১৫ ছাড়িয়ে যেত।

এরপর বিয়ের ব্যাপারে মেয়েদের নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ ও মতামত ধীরে ধীরে জোরালো হতে থাকে। মেয়েরা সমবয়সী বা কিছুটা বড় ছেলেদের জীবনসঙ্গী হিসেবে বাছাই করতে চাইলেন বেশি। বয়সের ব্যবধান তিন বা পাঁচ বছর ছাড়িয়ে গেলে অভিভাবকদেরও ভ্রু কুঁচকাত। তাঁদের আশঙ্কা ও সন্দেহ, বয়সের ব্যবধান বেশি হলে পদে পদে মতের অমিল হতে পারে, দেখা দিতে পারে প্রজন্মের ব্যবধান বা জেনারেশন গ্যাপ। দুই প্রজন্মের দুজন মানুষ পরস্পরকে বুঝতে পারবেন না, কষ্ট হবে মানিয়ে নিতে।

সমবয়সীদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ভালো হয়-এমন ধারণা পোষণ করতে শুরু করলেন অনেকে।

ইদানীং অনেক মেয়েকেই দেখা যায় একটু বেশি বয়সী কাউকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করতে দ্বিধা করছেন না। এর কারণটা হয়তো বৈষয়িক। এমন মনে করেন বেসরকারি কলেজের একজন অধ্যাপক রেহনুমা খানম। তাঁর নিজের দুটি মেয়ে রয়েছে। বড়টির সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে সাত বছরের বড় এক প্রকৌশলীর সঙ্গে। রেহনুমা বলেন, ‘যেহেতু আমার মেয়ের কোনো নিজস্ব পছন্দ ছিল না, তাই আমরা যখন ওর জন্য পাত্র খুঁজতে শুরু করলাম।
স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব দিলাম পাত্রের যোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠার ওপর। আর আজকালকার যুগে একটা ভালো চাকরি পেতে ও মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত অবস্থানে পৌঁছাতে একটা ছেলের খানিকটা বয়স হয়েই যায়। তার পরও বয়সের ব্যবধানের কথা ভেবে আমরা খানিকটা দমেই গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ে যখন কোনো আপত্তি করেনি, তখন আমরাও নিশ্চিন্ত হলাম।’ রেহনুমার নিজের বিয়ে হয়েছিল সহপাঠীর সঙ্গে, দাম্পত্য জীবন খুবই নির্বিঘ্ন ও সুখের হলেও সমবয়সের বিয়ের কারণে যথেষ্ট সংগ্রাম ও চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে তাঁদের।

প্রকৃতপক্ষে, পরস্পরকে বোঝার ও জানার মনোভাব যত ইতিবাচক হবে, তত বেশি সহজ মানিয়ে নেওয়াটা-এমন মত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নিলুফার আখতার জাহানের।

তিনি মনে করেন, বয়স বেশি হলেই যে কেউ সময়ের চেয়ে পিছিয়ে পড়বেন, এমন তো কোনো কথা নেই। সুখী দাম্পত্য জীবনের জন্য স্বামী-স্ত্রীর বয়স ও অবস্থান বা বয়সের ব্যবধান কখনো কখনো বিবেচ্য হতে পারে বৈকি, কিন্তু একমাত্র বিবেচ্য বিষয় নয়।

পারস্পরিক সমঝোতা, বিশ্বাস আর বোঝাপড়াতেই একটি দাম্পত্য সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে এবং মজবুত হয়। এখানে বয়সে বেশ বড় স্বামীকে স্ত্রী আস্থা আর ভালোবাসার জায়গায় রাখতে চান না। স্বামীর আচরণে যদি ‘প্যারেন্টিং’ ফুটে ওঠে, তবে সে সম্পর্ক কি সুখের হবে? আর স্ত্রীও যদি প্রতি পদক্ষেপে অপরিপক্কতা দেখান তবে সেটাও কি ভালো? বরং দুজনে যত খোলা মন নিয়ে এগিয়ে আসবেন, বয়সের ব্যবধান ততই তুচ্ছ হয়ে উঠবে।

দুজন যদি দুজনার হয়ে ওঠেন, নিজেদের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ ঠিকঠাক থাকে, তাহলে দেখা যায়, বয়সের ব্যবধান কোনো ব্যাপারই না। বয়স তখন ‘অসম’ হলেও পারস্পরিক বোঝাপড়াটা হয়ে যায় ‘সম’।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More