টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ‘বিসিবি সেলিব্রেশন কনসার্ট’-এ বাংলাদেশের অন্যতম ব্যান্ড দল ‘মাইলস’ এর পারফর্ম করার কথা থাকলেও তাদের স্টেজে উঠতে দেওয়া হয়নি। এছাড়াও সেলিব্রেশন কনসার্ট নিয়ে চলছে ব্যাপক সমালোচনা। এসবের মধ্যেই মাইলস-এর হামিন আহমেদ মুখোমুখি হয়েছেন ।
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে যে সেলিব্রেশন কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে মাইলস এর পারফর্ম করার কথা থাকলেও মাইলস পারফর্ম করেনি এবং কনসার্টের মঞ্চে এলআরবির আইয়ুব বাচ্চুর মন্তব্য, তার ফেসবুক স্ট্যাটাস এবং এরপরে আপনার স্ট্যাটাস নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়াতে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে। আপনি একটু বলবেন কি, আসলে কী হয়েছিল?
হামিন আহমেদ: যেটা হয়েছিল সেটা হচ্ছে, আমাদের মাইলস এর ইতিহাসে এতো বড় অপমানিত আগে হয়নি। মাইলস অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও, সময়মতো উপস্থিত থাকলেও এবং স্টেজের পাশে উপস্থিত থাকলেও মাইলসকে পারফর্ম করতে দেওয়া হয়নি। এর পেছনে কনসার্টের সার্বিক ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ‘গ্রে’ এরজন্য সম্পূর্ণ দায়ী। মাইলসকে না বাজাতে দেওয়ার এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্য পুরোপুরি ‘গ্রে’ দায়ী।
প্রশ্ন :বিষয়টি নিয়ে মাইলস কি অফিসিয়ালি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গ্রে’কে জিজ্ঞাসা করেছে?
হামিন আহমেদ: আমরা গ্রে’র সাথে কোনো কথাই বলবো না। আমরা ওখানে ছিলাম। আপনার এটা বুঝতে হবে মাইলস এর মতো একটি ব্যন্ড যখন পারফর্ম করতে স্টেজে দাঁড়ায় তখন তা প্রস্তুতি নিয়েই দাঁড়ায়। আমরা তো কম শো করি নাই। আমরা উপস্থিত থাকতেও আমাদের স্টেজে উঠতে বাধা দেওয়া হয় নাই। আমাদের পারফর্ম করতে দেওয়া হবে না বলে গ্রে’র কিছু এক্সিকিউটিভ এর মুখ থেকে শোনা গেছে এবং ওই সময় আমাদের ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গ্রে’র কোনো অফিসিয়াল আমাদের এটেন্ড করতে আসে নাই। এছাড়া আইয়ুব বাচ্চুর যে উক্তি এবং স্ট্যাটাস নিয়ে আমি কোন কথা বলতে চাই না, উনি কী বলেছিলেন না বলেছিলেন।
কিন্তু আমি ফেসবুকে যা লিখেছি তা কারেক্ট পিকচার এবং এর কোনোটাই বাড়িয়ে বলা হয় নাই। এছাড়া একটি বিষয় খেয়াল করুন, যেখানে একটি ব্যান্ডের সাথে আরেকটি ব্যন্ডের প্রায় ২৫ বছরের সম্পর্ক সেখানে এটা আশা করাটাই স্বাভাবিক যে এরকম একটি ইভেন্টে অন্যায় কাজ হচ্ছে এবং যেখানে সময় এত বাধা।
সোলসের পরে যেখানে তৃতীয় ব্যন্ড হিসেবে মাইলসের ওঠার কথা এবং আমরা উপস্থিত থাকার পরও সেখানে এলআরবিকে উঠালো। এলআরবি ইচ্ছা করলেই বলতে পারতো আমরা উঠবো না মাইলসের বাজানোর কথা মাইলস বাজাবে এখন। এলআরবির সাথে তো মাইলস এর কোনো সমস্যা ছিল না। আর সমস্যা যদি থেকেও থাকে তারপরেও দেশীয় দুটি ব্যান্ড, সমপর্যায়ের দুটি ব্যান্ড। সেখানে এলআরবি বলতে পারতো কেন আমি যাব? এখন তো মাইলস যাবার কথা।
এছাড়া যদি ধরেই নেই যে, একটা চাপের মুখে এলআরবিকে স্টেজে ওঠানো হয়েছে তাহলে দ্বিতীয় প্রেক্ষাপটে আসি। এলআরবির শ্লট অনুসারে ২০ মিনিট বাজানোর পরে তাদের তো বলা উচিত ছিল যে, আমরা আর বাজাবো না। যেখানে মাইলসকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। একথা আমি বলতেই পারি, যেখানে মাইলস এর সাথে এলআরবির ২৫ বছর ধরে মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে একই স্টেজ শেয়ার করছে। মাইলস এটা এলআরবির কাছে আশা করবে না কেন? আরেকটা বিষয়, এলআরবি পারফর্ম করার পরেও যদি উল্লাস না করে স্টেজ হতে নামার পরে একটা ‘হাই-হ্যালো’ বা ‘হামিন ভাই কি হয়েছে?’ বলতো তাহলে বুঝতাম… উনারা (এলআরবি) যে এখন বলছেন ‘বড় ভাই এটা বললেন সেটা বললেন’। ওই সময় বড় ভাই (মাইলস) কোথায় ছিল?
২৫ বছরে মাইলস এলআরবি’কে কী দিয়েছে এটা আইয়ুব বাচ্চু ভাল করে বলতে পারবে। আমরা সব বিষয় বলে বেড়াই না যে কার জন্য কী করেছি। তার মানে এই না যে, মাইলস দেশের মিউজিক ইন্ডাষ্ট্রি এবং এলআরবির জন্য কিছু করে নাই। আমরা আসলে মুখ খুলি না। এত কথা বাদ দিন, ধরুন মাইলস এলআরবিকে চেনে না বা এলআরবি মাইলসকে চেনে না। তারপরেও একই দেশের ব্যান্ড হিসেবে আমি যখন বুঝতে পারছি, এখানে অন্যায় কিছু হতে যাচ্ছে বা আমার (এলআরবির) কন্টাক্টের বাইরে অতিরিক্ত কিছু করতে বলা হচ্ছে। সেখানে তারা বলতে পারতো ‘ না, স্যরি’। আর এলআরবির অবস্থান তো এমন না যে দুইদিন আগের ব্যান্ড যে কেউ চাপ দেবে ‘এই আপনাকে বাজাতে হবে’।
মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে এলআরবি কিছু বললে শুনতে হবে বা মাইলস কিছু বললে শুনতে হবে, এটা হয়েছে স্ট্যাটাসের কারণে। এইজন্য আমরা বলতেই পারি যে, তাদের বলা উচিত ছিল বা বলা উচিত যে, না আমরা পারফর্ম করবো না, মাইলস অপেক্ষা করছে ওদের উঠতে দেন। আচ্ছা এটাও বাদ দ্যান, তাকে যা বলা হোক বা মিসগাইড করা হোক না কেন, তারপরেও কি স্টেজ থেকে নেমে সৌজন্যভাবে তার (আইয়ুব বাচ্চু) কাছে ‘হাই-হ্যালো বা হামিন ভাই কি হয়েছে?’ এটা কি আশা করা যায় না?
প্রশ্ন: আপনি এতক্ষণ যা বললেন ‘গ্রে’ এবং এলআরবি সর্ম্পকে, আপনার কি মনে হয় এসব পূর্ব পরিকল্পিত?
হামিন আহমেদ: আমি জানি না, এটা কোথাকার পরিকল্পিত। তবে আমার কাছে সব তথ্য আছে যে এটা গ্রে’র দ্বারা হয়েছে।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি কি মনে করেন গ্রে’র সাথে বিষয়টিতে এলআরবি জড়িত বা তারা বুঝে/না বুঝে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী?
হামিন আহমেদ: না আমি এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবো (এলআরবি জড়িত না)। বুঝে বা না বুঝের কথা বাদ দিয়ে হলেও ওই পরিস্থিতি বাংলাদেশি ব্যান্ড হিসেবে এলআরবি দেখে ফেলেছে যে দেশি আরেকটা ব্যন্ড ওইখানে অপেক্ষা করছে। তখন তারা বলতো পারতো আমি (এলআরবি) আর অতিরিক্ত পারফর্ম করবো না। আমরা (মাইলস) হলেতো তাই করতাম। এছাড়া আপনি একটা বিষয় জেনে রাখুন, লোকাল কনসার্টগুলোতে পারফর্মেন্স কোনটা সময়মতো হয় কোনটা হয়না। কিন্তু এটাতো লোকাল কনসার্ট না, যে আপনার অফুরন্ত সময় আছে। এখানেতো বোঝাই যাচ্ছে যে যারা ম্যানেজমেন্ট আছে তারা পাগল হয়ে যাচ্ছেন যে ভারতীয় বা বিদেশী শিল্পীদের কিভাবে এডজাষ্ট করা যাবে। অনেকটা মিলিটারি প্যারেড এর মতো নিয়ম-কানুন, সেখানে এটা কি কারো বোধগম্য হবে না। এটা বিশ্বাস করা কঠিন যে আমাকে (এলআরবিকে) বললো আর ২০ মিনিট বেশি বাজিয়ে দিলাম?
প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাংলাদেশে হচ্ছে এবং সেলিব্রেশন কনসার্টের আয়োজক বিসিবি। কিন্তু অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় শিল্পীদের আধিক্য নিয়ে যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, সে বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
হামিন আহমেদ: আমার জানামতে এটা বিসিবি’র প্রেজেন্টেশান এবং এটাকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অনুষ্ঠানের বিভিন্ন পর্ব পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ‘গ্রে’। সেজন্য তাদের দায়-দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।
এবার আসি বিদেশি শিল্পী প্রশ্নে, এই অনুষ্ঠানে কোন কোন শিল্পী আসবে এবং বাজাবে। তাদের মোষ্ট ওয়েলকাম। এমন তো নয় যে, এটাই প্রথম কোন কনসার্ট। এর আগেও অনেক বিদেশি-ভারতীয় শিল্পী এসেছে। আগেও তাদেরকে এপ্রিসিয়েট করেছি এবারও করেছি, যেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার পাশাপাশি আপনি যদি বাংলাদেশি শিল্পীদেরকে, বাংলাদেশের কালচারকে ন্যায্য বা যথেষ্ট সময় না দেন তাহলে প্রশ্ন তো উঠবেই। ধরুন ইভেন্টটি ভারতে হচ্ছে তাহলে ভারত অবশ্যই তাদের শিল্পী এবং কালচারকে প্রাধান্য দিত। সেই সঙ্গে বিদেশি শিল্পীদের একটু হলেও কম প্রাধান্য দিত। এখানে আমি প্রাধান্য দেওয়ার কথা বাদ দিলাম। অন্তত সমপর্যায়ে হলেও কথা ছিল না। সাবিনা ইয়াসমিনের মতো একজন শিল্পীকে ৩ মিনিট সময় দেওয়া আর বিদেশি শিল্পীকে ৩ ঘন্টা সময় দেওয়া, এটা তো চরম অবমাননা। আমাদের কথা না হয় নাই বললাম। তারপরেও আমাদের ১ ঘন্টা বাজাতে দিত, দেখতাম কি হয়। এখানে আসলে বাংলাদেশি শিল্পীদের অত্যন্ত ছোট করা হয়েছে, অপমান করা হয়েছে।
প্রশ্ন: সামাজিক গণমাধ্যম ফেসবুকে এবং বিভিন্ন অনলাইন ফোরামে আলোচনা চলছে যে বিদেশি শিল্পীরা ঠিকই তাদের চাহিদা এবং সন্মান মোতাবেক পারফর্ম করে গেলেন। কিন্তু আমাদের দেশি শিল্পীরা অবহেলিত হলেন এবং পরবর্তীতে নিজেরা নিজেদের মধ্যে ব্লেইম গেইম চলছে। এ বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখছেন?
হামিন আহমেদ: দেখেন, ওইদিন ওইখানে যা হয়েছে তার জন্য প্রথম পর্যায়ে কি দায়িত্ব এলআরবির ছিল না? একটা বাংলাদেশি ব্যান্ডকে বাদ দেয়া হচ্ছে, কেন বাদ দেওয়া হচ্ছে? এটা সম্পর্কে বাংলাদেশি ব্যান্ড হিসেবে তাদের কি কোনো মাথা ব্যাথা ছিল না? মানুষের চেহারা দেখলে বোঝা যায়, আমি তাদের চেহারা দেখেছি, দেখেছি তাদের উল্লাস। আই অ্যাম স্যরি টু সে, এরজন্যই আমি ফেসবুকে একটি ‘বিশেষ উক্তি’ করেছিলাম তাদের সর্ম্পকে। আপনাকে বুঝতে হবে আমাদের পেছনে অনেকটা ছুরিকাঘাত এর মতো ঘটনা ঘটেছে, এটা ছোট কোনো ঘটনা না। মাইলস-কে একটি ইভেন্টে নিয়ে গিয়ে, তাদের উপস্থিতকালীন সময়ে তাদের পারফর্ম করতে দেওয়া হয় নাই। আপনি কি মনে করেন, আমাদের রিঅ্যাকশন কী হওয়া উচিত? এক্ষেত্রে কে কী মনে করছে, এটা নিয়ে কি বসে থাকবো? মাইলসের কি মিউজিক ইন্ডাস্টিতে কি কোনো অবদান নাই? আমরা মনে করি, কিছু কিছু জিনিসের ক্ষেত্রে এসব চিন্তা করতে হয় না। যা সত্যি তার মুখোমুখি হতে হয়। আপনাকে প্রটেস্ট করতেই হবে।
শেষ প্রশ্ন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এবং মাইলস ভক্তদের উদ্দেশ্য আপনার কোনো ম্যাসেজ?
হামিন আহমেদ: এব্যাপারে আমার একটাই কথা। মাইলসের ফ্যানরা মাইলসকে ভালো করেই চেনে। মাইলস ফ্যান এবং দেশের মিউজিক লাভারদের আমি বলবো, মাইলস যদি দেশের প্রথম সারির একটা ব্যান্ড হয় এবং যারা বিশ্বের দরবারে- যেমন সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন মিডিয়াতে ওঠে আসে। সেই মাইলসকে যেভাবে অপমানিত করা হয়েছে তার প্রতিবাদ মাইলস করছে-করবে-করতেই থাকবে এবং তার জন্য যে আলোচনা-সামলোচনার ঝড় বইছে তা বইতেই থাকবে। কারণ এই ক্ষতটা পূরণ হবে না। সেইসাথে ফ্যানদের বলবো মিথ্যাচারে বিভ্রান্ত হবেন না। আমরা বিবাদ-মারামারি চাচ্ছি না, আমরা চাচ্ছি একটা অন্যায় হয়েছে যার কারণে মাইলসের ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এবং এটা আমাদের কাছে দুঃস্বপ্ন, আমরা এটা মেনে নিতে পারছি না। আর ওই ঘটনার পরে যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে তারজন্য মাইলস খুবই দুঃখিত।