আব্দুল আলীম ও শামছুজ্জামান নাঈম
ঢাকা: সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই সংশোধনীর ফলে যারা ক্ষমতায় থাকবে তাদের অধীনে নির্বাচন হবে। আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তাদের স্বতন্ত্র ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষমতাসীনদের অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করবে। অতএব পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হওয়ার সম্ভাবনা আশা করা যায় না। এক কথায় নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
সোমবার রাজধানীর আসাদ অ্যাভিনিউতে সুজন কার্যালয়ে আরটিএনএন-কে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গত ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। আমাদের নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট। তারা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছে।
তিনি বলেন, মানুষ ভোট দিতে না যাওয়ায় মাত্র কয়েক শতাংশ ভোট পড়লেও এই ধরনের নির্বাচন না করতে দেয়ার জন্য নাগরিকের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করা উচিৎ ছিল। গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে নাগরিকের অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। যদি তারা সেই ভূমিকা পালন না করে তবে তারা বঞ্চিত হবে। স্বার্থান্বেষীরা অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সরকারের গত ৫ বছরে দুদক, নির্বাচন কমিশনসহ যতগুলো কমিশন হয়েছে সবগুলোই পক্ষপাতদুষ্ট। এসব কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। এসব কমিশনকে অনুগত হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে কাজ করা দেশের শীর্ষস্থানীয় এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার বলেন, জাতীয় পার্টির কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নেই। বড় দুই দলের অব্যাহত ব্যর্থতায় জামায়াতে ইসলামীর মাথাচাড়া দিয়ে উঠার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ২০০৮ এর আগে বিএনপি ছিল ধিকৃত, এখন আওয়ামী লীগ তাদের ছাড়িয়ে অধিকতর ধিকৃত হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ এর থেকে পরিত্রাণ পেতে উপজেলা নির্বাচনে দুর্ভাগ্যবশত এই উগ্রবাদী শক্তিকেই আকর্ষণীয় মনে করেছে। নির্বাচিত করেছে তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে।
আরটিএনএন-এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এমন অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-
আরটিএনএন: সুজনের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর, নির্বাচনী ব্যবস্থাকে সুসংহত, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অবদান এবং একটি জনকল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০০২ সালে সুজনের আত্মপ্রকাশ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা জনসচেতনতা ও বিভিন্ন রকম সংস্কারের ব্যাপারে কাজ করেছি- যেমন নির্বাচনী ব্যবস্থা, রাজনৈতিক সচেতনতা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সংস্কার। এছাড়া প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করেছি। এগুলো করতে আমরা অ্যাডভোকেসি করেছি। এটা নিয়ে ডিমান্ড তৈরি করেছি। অপর দিকে এটি কার্যকর করার জন্য প্রার্থী ও ভোটারদের মুখোমুখি অনুষ্ঠান করেছি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কুমিল্লার লাকসামে। তিনি একজন অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এবং সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি, সিয়াটোল ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি ও সেন্ট্রাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে তিনি শিক্ষকতা করেছেন। সৌদি রাজ পরিবারের অনুরোধে দীর্ঘ সময় তিনি দেশটির অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি নাসাতেও কনসালটেন্ট ছিলেন। |
আরটিএনএন: অনেকে বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনাররা বলে থাকেন, আপনারা বিভিন্ন সময় যে তথ্যগুলো দিয়ে থাকেন সেগুলো বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং। আপনাদের নিজস্ব কোনো গবেষণা নেই। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এটা একেবারে মিথ্যা কথা। আমরা প্রার্থীদের ব্যাপারে যেসব তথ্য দিয়ে থাকি সেগুলো প্রার্থীদের দেয়া তথ্যানুযায়ী। এছাড়া আমাদের নিজেদের গবেষণা আছে। সরকার টিআইবির বিষয়েও বলে থাকে এটি তাদের মনগড়া রিপোর্ট, তবে তাদের বেলায়ও কথাটি সত্য নয়। তাদেরও গবেষণা আছে।
আরটিএনএন: সুজনসহ কিছু সংগঠনের আন্দোলনের ফলে দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার হয়েছিল এবং সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটি ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখন সেটি কোনো অবস্থায় আছে?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আইনি কাঠামোর ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা বা দুর্বল করা হয়েছে। ২০০৮ সালে নির্বাচনী আইন কাঠামোতে যে সংস্কারগুলো করা হয়েছিল এরপর সংসদ এটাকে অনুমোদন করেছে কিছু কিছু বাদ দিয়ে। এ কারণে আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পেছনের দিকে চলে গেছি। যেমন- আগে তৃণমূলের কমিটিগুলোর সুপারিশের ভিত্তিতে যে প্যানেল তৈরি হতো সেই প্যানেল থেকে মনোনয়ন দেয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সংসদ যখন অধ্যাদেশ অনুমোদন করে তখন প্যানেল বিবেচনায় নিয়ে মনোনয়ন দেয়ার বিধান পাস করা হয়। অর্থাৎ প্রার্থী হতে তৃণমূলের সুপারিশের আর বাধ্যবাধকতা রইল না।
আরটিএনএন: নির্বাচন কমিশনার বিগ্রে. জেনা. জাবেদ আলী বলেছেন, ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের চেয়েও শক্তিশালী বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন। আপনার কি মনে হয়?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আইনগত দিক থেকে আমাদের নির্বাচন কমিশনকে কিছুটা শক্তিশালী বলা যায়। কারণ আমাদের নির্বাচন কমিশনের বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা আছে কিন্তু ভারতের নির্বাচন কমিশনের তা নেই। তবে তাদের নির্বাচন কমিশনে যেসব ব্যক্তিরা নিয়োগ পায় তারা সবাই নিরপেক্ষভাবে কাজ করে। সামান্য কয়েকটি ভোটের জন্য একাধারে তিন দিন হাতির পিঠে চড়ে গুটিকয়েক ভোট কাস্ট করার রেকর্ডও তাদের আছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা হলেও যে কাঠামো আছে তাতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব। এর জন্য একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন দরকার- যে কমিশন সাহসী, কোনো দলের প্রতি অনুগত থাকবে না বা কোনো দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে না, জনস্বার্থে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে।
অথচ শক্তিশালী আইনী কাঠামো থাকার পরও গত ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। কারণ আমাদের নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতদুষ্ট। তারা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করেছে।
আরটিএনএন: প্রেসিডেন্টের সার্চ কমিটির মাধ্যমে বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা কেনো পক্ষপাতদুষ্ট হলো?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: প্রথমত সেই সার্চ কমিটি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে কাজ করেনি। এতে কিছু কিছু লোক পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। আমাদের দাবি ছিল, রাষ্ট্রপতির সেই সার্চ কমিটি কোন মানদণ্ডের ভিত্তিতে, কাকে কাকে নির্বাচন করবে সে সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করার যাতে সার্চ কমিটিতে দলীয়করণ না করা হয়। কিন্তু তা আমাদের জানানো হয়নি। সে সম্পর্কে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।
আরটিএনএন: উপজেলা নির্বাচনের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ দেশে ছিলেন না। ফিরে এসে নির্বাচনে সহিংসতার দায়ভার নিতে অস্বীকৃতি জানান। সহিংসতার দায়ভার সিইসির না হলে কার?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সহিংসতার দায়ভার অবশ্যই সিইসির। এগুলো চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয়। এমন অবস্থায় তাদের সাংবিধানিক পদ আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো অধিকার নেই। তাদের দায়িত্ব হল সুষ্ঠু নির্বাচন, নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা, নির্বাচনী আইনের যথাযথ প্রয়োগ।
তা যদি না করে তবে ওই পদে থাকার কোনো অধিকার তাদের নেই। অন্যান্য দেশের নির্বাচন কমিশন কোনো প্রকার ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগ করে। অথচ আমাদের দেশের কমিশনাররা তাদের পদ আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। তারা পক্ষপাতদুষ্ট বলেই পদত্যাগ করছেন না।
আরটিএনএন: উপজেলা নির্বাচনে সহিংসতা ও বিতর্কমুক্ত হলে ফলাফল কেমন হতো বলে মনে করেন। কোন দল কতটি উপজেলায় বিজয়ী হত?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: কারচুপিমূলক নির্বাচন হওয়া সত্ত্বেও প্রথম ধাপের নির্বাচনগুলোতে বিরোধী দল অনেক ভাল ফলাফল করছিল। কিন্তু ধাপ যত অতিক্রম করছিল ততই নির্বাচনে কারচুপি বাড়ছিল। ব্যালটবক্স ছিনতাই, কেন্দ্র দখল ও সহিংসতার ফলে বিরোধীদল পরবর্তী ধাপগুলোতে খারাপ করেছে। এত কিছু সত্বেও সরকারি দল ততোটা ভাল করেনি। সুনির্দিষ্টভাবে বলা না গেলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হলে সরকারি দল আরো খারাপ করতো।
আরটিএনএন: উপজেলা নির্বাচনে অনেক প্রার্থীর যোগ্যতা থাকা সত্বেও তাদের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে অন্যদিকে সরকারী দলের অনেকের যোগ্যতা না থাকলেও তাদের প্রার্থিতা বৈধ রাখা হয়, যা উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আপনাদের দেয়া পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে। এটিকে কিভাবে দেখছেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এ নির্বাচন কমিশন তো পক্ষপাতদুষ্ট। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মনোনয়ন প্রত্যাহার করলেও তারা তা গ্রহণ না করে ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছে অনুযায়ি কাজ করেছে। উপজেলা নির্বাচনে যোগ্যতা থাকা সত্বেও তারা (কমিশন) অনেকের প্রার্থিতা বাতিল করেছে। আবার অনেকের যোগ্যতা না থাকলেও বৈধতা দিয়েছে। আমরা মনোনয়ন থেকে শুরু করে প্রার্থীদের তথ্য, আইনি কাঠামোসহ নির্বাচনের পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটাকে পর্যবেক্ষণ করি। এরকম আরো বহু জায়গায় বহু রকম অভিযোগ রয়েছে।
আরটিএনএন: ইতিপূর্বে আপনারা নির্বাচনের প্রক্রিয়া সংশোধনের জন্য আইনি লড়াই করেছেন। এখন আপনাদের ভাষায় এই পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিবেন কি না?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আইনি লড়াই বা আন্দোলন করে এটার কোন সুফল পাওয়া যাবে না। এটার জন্য সকল নাগরিককে এক হতে হবে। সবাইকে প্রতিবাদী হতে হবে। তবে কিছু একটা হতে পারে।
আরটিএনএন: উপজেলা নির্বাচনে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কি?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: জাতীয় পার্টির কোনো রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ আছে আমি মনে করি না। দে হ্যাভ লস্ট অল দ্যা ক্রেডিবিলিটি (তারা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে)। তাদেরই দলের একজন (জিএম কাদের) বলেছেন, ‘একই সঙ্গে এক দলের গোলরক্ষক হওয়া এবং আরেক দলের সেন্টার ফরওয়ার্ড হওয়া সম্ভব না।’
অথচ তারা পুরোপুরি নিজস্বার্থ প্রণোদিত হয়ে সেগুলোই করছে। আমার মনে হয় দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এটা পরিষ্কার তারা ‘আগারটাও খাবে, গোড়ারটাও খাবে।’ জনস্বার্থ রক্ষার পরিবর্তে তারা কিছু লোকের মন্ত্রী হওয়াকেই বেছে নিয়েছে।
আরটিএনএন: অনেকের আশঙ্কা এই অবস্থা চলতে থাকলে এবং বড় দুই দলের ব্যর্থতায় জামায়াতের উথান হতে পারে। আপনারা কি মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আমারও আশঙ্কা উগ্রবাদী শক্তি এদেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেও উঠতে পারে। কারণ- বিএনপি চরমভাবে বিতর্কিত, তারা বহু অপকর্ম করেছে। আওয়ামী লীগও অপকর্মে বিএনপিকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখন সাধারণ মানুষ প্রতি পদে পদে হয়রানির শিকার হচ্ছে। আদালতে কিংবা সরকারি অফিস যেখানেই যান আপনার হয় টাকা লাগবে না হয় তদবির লাগবে। এর বাহিরে আপনি অন্যায়ের প্রতিকার কোথাও পাবেন না। জনগণ তো এর থেকে পরিত্রাণ চাইবেই। তখন দুর্ভাগ্যবশত এই উগ্রবাদী শক্তিকেই সাধারণের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে।
আরটিএনএন: উগ্রবাদী শক্তি হিসেবে কি শুধু জামায়াতে ইসলামীকেই বুঝাচ্ছেন নাকি জেএমবি বা অন্যান্য যে সংগঠনগুলো রয়েছে সেগুলোকেও মনে করছেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: উগ্রবাদী শক্তি হিসেবে শুধু জামায়াতে ইসলামিই না, ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে বলতে চাচ্ছি। এদেশে রাজনীতি করার জন্য আমরাই তাদের মাঠকে উর্বর করে দিচ্ছি।
আমাদের গণতন্ত্র বলতে তো নির্বচনী গণতন্ত্র অর্থাৎ একদিনের গণতন্ত্র ছিল। এখন তো সেটাও নেই। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের বিধান করার মাধ্যমে তো এখন আর কিছুই রইলো না।
আরটিএনএন: উপজেলা নির্বাচনে জামায়াতের ভাল ফলাফলের কারণ কি বলে মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি ছিল চরমভাবে ধিকৃত। এখন আওয়ামী লীগ তাদের চেয়ে বেশি ধিকৃত। সাধারণ মানুষ এদের থেকে পরিত্রাণ চায়। তাই বিশেষ করে ধর্মভীরু মানুষগুলোর কাছে দুর্ভাগ্যবশত জামায়াতকেই বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়। এ কারণে তাদের দিকে ঝুঁকছে আর তাদের সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছে।
মানুষ ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে বিএনপিকেও দেখেছে আওয়ামী লীগকেও দেখছে। জনগণের স্বার্থ রক্ষায় কেউ কাজ করে না। সাধারণ মানুষ সবসময় হয়রানির শিকার হচ্ছে। এখন থানাতে একটা জিডি করতে গেলে ক্ষমতাসীনদের অনুমতি লাগে। তাছাড়া ক্ষমতাসীনদের কেউ যদি আপনার জিডি নিতে নিষেধ করে তাহলে পয়সা দিয়েও আর জিডি এন্ট্রি করাতে পারবেন না।
আরটিএনএন: বর্তমান সংকটের জন্য বিএনপি বা আওয়ামী লীগ, কে কতটা দায়ী?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: বর্তমান সংকটের জন্য সবাই দায়ী। প্রত্যেকেরই লক্ষ্য জনকল্যাণমূখী হওয়া উচিৎ ছিল। আওয়ামী লীগের একতরফা এবং কারসাজিমূলক নির্বাচন করা উচিৎ হয়নি। নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে আলাপ আলোচনার দরকার ছিল। অপরদিকে বিএনপিরও আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা উচিৎ ছিল।
এছাড়া আমরা নাগরিক সমাজও দায়ী। কারণ আমাদের যে প্রতিবাদ করা বা করণীয় ছিল সেটা আমরা করিনি। মানুষ ভোট দিতে না যাওয়ায় মাত্র কয়েক শতাংশ ভোট পড়লেও এই ধরনের নির্বাচন না করতে দেয়ার জন্য নাগরিকের অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করা উচিৎ ছিল। গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে নাগরিকের অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকা পালন করতে হবে। ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। যদি তারা সেই ভূমিকা পালন না করে তবে তারা বঞ্চিত হবে। স্বার্থান্বেষীরা অন্যায় করে পার পেয়ে যাবে।
আরটিএনএন: চলমান সংকট থেকে উত্তরণের পথ কি?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: রাজনৈতিক দলগুলোর প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম ও মানুষের কল্যাণের প্রতি তাদের অঙ্গীকারগুলো পূরণ করতে হবে। ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থের উর্ধে উঠে যদি তারা জনকল্যাণে কাজ করে তবে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে পারে।
তবে এটা আশা করা যায় না। কারণ যারা এটা ভোগ করছে এইগুলো করা তাদের স্বার্থের অনুকূলে নয়। এক্ষেত্রে আমাদের নাগরিকদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে সোচ্চার ও সক্রিয় হতে হবে। জাগ্রত জনতাই সংকট উত্তরণের একমাত্র রক্ষাকবচ।
আরটিএনএন: দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত জোটের ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও শুধু নির্বাচনী ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থার ফলে তারা নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এ অবস্থায় দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কি?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পর থেকে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এই সংশোধনীর ফলে যারা ক্ষমতায় থাকবে তাদের অধীনে নির্বাচন হবে। আইনশৃংখলা বাহিনী, প্রশাসনসহ সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তাদের স্বতন্ত্র ক্ষমতা হারিয়ে ক্ষমতাসীনদের অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করবে। অতএব পঞ্চদশ সংশোধনী বহাল থাকলে অদূর ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার বদল হওয়ার সম্ভাবনা আশা করা যায় না। এক কথায় নির্বাচনী গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
আরটিএনএন: তৃতীয় বিশ্ব বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে নির্বাচন নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়। এর কারণ কি?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: এর কারণ আমাদের ন্যায় তাদের মধ্যেও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব। মুসলিম দেশগুলোতে বা আমাদের দেশে সেই রকম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। খেলার তো একটি নিয়ম থাকে। গণতন্ত্রকে যদি খেলা হিসেবে ধরি তবে তারও একটা নিয়ম থাকে। আমরা বা মুসলিম দেশগুলো এইসব মানে না। তাদের মধ্যে সেই রকম মূল্যবোধ গড়ে ওঠেনি। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য কতগুলো নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার। যেমন নির্বাচন কমিশন ও আদালত। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো এসব দেশে গড়ে ওঠেনি। এ কারণে এসব দেশে নির্বাচন পক্ষপাতদুষ্ট ও কারচুপি হয়।
আরেকটা জিনিস হল- তথাকথিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পর লুটপাট করে পার পেয়ে যায়। অর্থাৎ এসব দেশে আইনের শাসন বিদ্যমান নেই।
আরটিএনএন: এনজিওগুলোকে চাপে রাখা বা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার একটি আইন করতে যাচ্ছে। সেটি এখন কোন অবস্থায় আছে? আইনটি বাস্তবায়ন হলে আপনাদের কাজ করতে সুবিধা/অসুবিধা কোনটি হবে বলে মনে করেন?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: বিষয়টি এখনও আইনে পরিণত হয়নি। এখন সরকার সবার কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করছে। সব প্রতিবাদী কণ্ঠকে তারা স্তব্ধ করার চেষ্টা করছে। তাদের সম্প্রচার নীতিমালা, এনজিও আইন এই উদ্দেশ্যেরই অংশ। আইন হয়ে গেলে যে কোন সময় যে কোন প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দিতে পারবে।
আরটিএনএন: সম্প্রচার নীতিমালা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
ড. বদিউল আলম মজুমদার: নীতিমালার মাধ্যমে নাগরিকদের কণ্ঠরোধ করা ও তাদের মুখে লাগাম লাগানোর সুযোগ তৈরি হবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে তথ্যমন্ত্রী বলছেন, সম্প্রচার কমিশন গঠন করা হবে। তার মধ্যে গণমাধ্যমের ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ থাকবে।
তবে এই সরকারের গত ৫ বছরে দুদক, নির্বাচন কমিশনসহ যতগুলো কমিশন হয়েছে সবগুলোই পক্ষপাতদুষ্ট। এসব কমিশনকে স্বাধীন বলা হলেও জনগণের স্বার্থ রক্ষায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। এসব কমিশনকে অনুগত হিসেবেই তৈরি করা হয়েছে।
আরটিএনএন: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: আপনাদের ও আরটিএনএন-এর সকল পাঠককে ধন্যবাদ।
>আরটিএনএন