ছেলে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে মা–বাবার জীবন হুমকিতে

0

ছেলে হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে রাজধানীর মিরপুরের লালকুঠির বাসিন্দা মো. বাবুলের জীবন এখন হুমকির মুখে। গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকা ও কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে আসা হত্যা মামলার আসামিরা সাবেক একজন যুবলীগ নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।

বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ জানানোয় ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দারুসসালাম থানার অধীন লালকুঠি এলাকায় কলেজছাত্র মো. মাহিনকে (শুভ) পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য যাঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, সেই শাহরিয়ার কবির ওরফে হৃদয় ও সিরাজুল ইসলাম ওরফে ভাগিনা সিরাজুল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করছে না।

আসামিদের অনবরত হুমকি-ধমকিতে মাহিনের মা-বাবা গত তিন মাসে দারুসসালাম থানায় তিনটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। সর্বশেষ জিডি করা হয় গত ২৬ জানুয়ারি। এতে উল্লেখ করা হয়, মাহিন হত্যা মামলার আসামি লালকুঠির বাসিন্দা কাউছার ও কায়সার ইমরান প্রদীপ কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। ২৫ জানুয়ারি রাতে তাঁদের নেতৃত্বে ১০-১২ জন সন্ত্রাসী বাবুলের (মাহিনের বাবা) বাসায় যান। তাঁরা তাঁকে মামলা তুলে নিতে ভয়ভীতি দেখান ও মেরে ফেলার হুমকি দেন।

পেশায় গাড়িচালক মো. বাবুল প্রথম আলোকে বলেন, মাহিন হত্যার সুষ্ঠু বিচারের জন্য তিনি আসামিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন।

এতে কিছু আসামি গ্রেপ্তার হলেও পরে কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে তাঁরা এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকা শাহরিয়ার কবির, ভাগিনা সিরাজুল ও জামিনে মুক্ত থাকা আসামিদের লাগাতার হুমকিতে তিনি এবং তাঁর পরিবার এখন নিরাপত্তাহীন ও শঙ্কিত। স্থানীয় সাবেক যুবলীগ নেতা ও ডিশ ব্যবসায়ী আবদুল কাদের জামিনে থাকা আসামি কায়সার ইমরান ওরফে প্রদীপ ও কাউছারকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন বাবুল।

আবদুল কাদের বৃহত্তর মিরপুর থানা ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত বলে দাবি করেছেন। অভিযোগের বিষয়ে আজ রোববার দুপুরে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কায়সার ইমরান ও কাউছারকে চিনি। দেখা হলে তাঁরা আমাকে সালাম দেন। তবে তাঁদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিই না। তারপরও অভিযোগ থাকলে মাহিনের পরিবার পুলিশকে জানাতে পারে।’

বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ জানানোয় ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দারুসসালাম থানার অধীন লালকুঠি এলাকায় কলেজছাত্র মো. মাহিনকে (শুভ) পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ হত্যাকাণ্ডের জন্য যাঁদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, সেই শাহরিয়ার কবির ওরফে হৃদয় ও সিরাজুল ইসলাম ওরফে ভাগিনা সিরাজুল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাঁদের গ্রেপ্তার করছে না।

আবদুল কাদের দাবি করেন, তিনি স্থানীয় সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি। তিনি সব সময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন।

মাহিনের মা–বাবার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দারুসসালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে বলেন, হুমকি–ধমকির ঘটনায় আসামিদের বিরুদ্ধে জিডি নেওয়া হয়েছে। হুমকিদাতারা জামিনে থেকে হুমকি–ধমকি দিলেও মামলায় তাঁদের তো দ্বিতীয়বার গ্রেপ্তার করা যায় না। আর গ্রেপ্তার হয়নি এমন আসামি থাকলে, অভিযোগপত্র দেখে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, এটি পুরোনো মামলা।



বোনকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর দারুস সালাম থানা এলাকায় কলেজছাত্র মাহিনকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেন সন্ত্রাসীরাছবি: সংগৃহীত

মাহিন হত্যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন পর্যন্ত ১২ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। কারাগারে আটক আছেন আসামি শফিকুর রহমান ওরফে অতুল। আর জামিনে মুক্ত আসামিরা হলেন রাকিব হোসেন, রাহিতুল হাসান ওরফে রিংকু, সাকলাইন খান, রিয়াজ আহম্মেদ ওরফে রিয়াজ, সুমন আকন, মো. রাকিব, ইমরান হোসেন, রাতুল ইসলাম ওরফে রাফি, বাদল মিয়া, মো. কাউছার, কায়সার ইমরান ওরফে প্রদীপ।

২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর লালকুঠির সি ব্লকের তৃতীয় কলোনিতে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা লাঠি, রড, ছুরি ও চাপাতি নিয়ে কলেজছাত্র মাহিনের ওপর হামলা চালান। তাঁকে পিটিয়ে, ছুরিকাঘাত করে ও কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে পালিয়ে যান তাঁরা। রক্তাক্ত অবস্থায় মাহিনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। আট দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৪ সেপ্টেম্বর মাহিন মারা যান।

মাহিন মিরপুরে সরকারি বাঙলা কলেজে পড়াশোনা করতেন। পাশাপাশি কাজ করতেন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রির। মাহিনের মা মরিয়ম বেগম ছেলে হত্যার ঘটনায় ছয়জনের নাম উল্লেখসহও অজ্ঞাতনামা আরও পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় মামলা করেন।

মাহিনকে খুন করার সময় তাঁর বাবা সৌদি আরবে ছিলেন। মাহিনের মা মরিয়ম বেগম বলেন, ওই সময় তাঁর মেয়েকে কলেজে যাওয়ার পথে উত্ত্যক্ত করতেন এজাহারভুক্ত আসামি শফিকুর। মাহিন প্রতিবাদ করায় শফিকুর ও তাঁর সহযোগীরা ক্ষিপ্ত ছিলেন। একপর্যায়ে বখাটে শফিকুরের উৎপাতে মেয়ের কলেজে যাওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হন। পরে মাহিনকে খুন করে সন্ত্রাসীরা। কায়সার, কাউছারসহ শফিকুরের সঙ্গীরা মাদকের কারবার ও ছিনতাইয়ে জড়িত বলেও অভিযোগ করেন মরিয়ম।

মরিয়ম বেগম বলেন, ২০১৮ সালে তাঁর স্বামী সৌদি আরবে থাকার সময় এজাহারভুক্ত আসামি কাউছার ও শফিকুরের সহযোগী আল আমিন, বিপ্লব ও সুমন তাঁদের লালকুঠির বাসায় ঢুকে তাঁকে ও তাঁর কলেজপড়ুয়া মেয়েকে মারধর করেন এবং ভয়ভীতি দেখান। এ ব্যাপারে তখন দারুসসালাম থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন তিনি।

পুলিশ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দারুসসালাম থানার লালকুঠি ও মাজার রোড এলাকায় কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন শফিকুর। দারুসসালাম থানায় তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই, খুনসহ আটটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া এজাহারভুক্ত আসামি রাকিব হোসেন, সাকলাইন খান ও বাদল মিয়ার বিরুদ্ধে দারুসসালাম থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।

মাহিনের বাবা মো. বাবুল ছবি: সংগৃহীত

মাহিনের বাবা মো. বাবুল ছবি: সংগৃহীত ছবি: সংগৃহীত

মাহিন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দারুসসালাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ সুলতান আলী এখন খিলক্ষেত থানায় কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তকালে এজাহারভুক্ত ছয় আসামি ছাড়াও মাহিন হত্যায় কয়েকজনের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। পরে ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন রাকিব হোসেন, রাহিতুল হাসান ওরফে রিংকু, সাকলাইন খান ওরফে তামিম, রিয়াজ আহম্মেদ ওরফে রিয়াজ, সুমন আকন্দ, মো. রাকিব হোসেন, কবির হোসেন, ইমরান হোসেন, বাদল মিয়া, সিরাজুল ইসলাম ওরফে ভাতিজা সিরাজুল ও শফিকুর রহমান ওরফে অতুল। জামিনে মুক্ত আছেন রাহিতুল হাসান, সাকলাইন খান ও রিয়াজ আহম্মেদ।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা না পাওয়ায় শাহরিয়ার, কাউছার ও কায়সার ইমরান ওরফে প্রদীপকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। পরে কায়সারের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা পাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আর শাহরিয়ার ও কাউছারের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করা সম্ভব হলে পুলিশ তাঁদের বিরুদ্ধেও সম্পূরক অভিযোগপত্র দেবে।

উৎসঃ   প্রথমআলো
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More