বাংলাদেশের অনুমতি ছাড়া টিপাইমুখে ভারত কোনো প্রকল্প নিতে পারবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “টিপাইমুখে কিছু করতে হলে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।”
রোববার সকালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে এসে তিনি এ কথা বলেন।
তিনি বক্তব্যের শুরুতে বলেন, “পানির অপর নাম জীবন। আমি আজ জীবনের কাছে এসেছি।”
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০০ কিলোমিটার উজানে ভারতের টিপাইমুখ গ্রামে বরাক এবং টুইভাই নদীর মিলনস্থল। হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে ভারত সরকার এ মিলনস্থলের ১ হাজার ৬০০ ফুট দূরে বরাক নদীতে ৫০০ ফুট উঁচু ও ১ হাজার ৬০০ ফুট দীর্ঘ বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে বেশ কয়েকবছর আগে।
বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী তিস্তা চুক্তি নিয়েও কথা বলেন। তিস্তার পানি হিস্যা নিয়ে সৃষ্ট সংকট সমাধান না হওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীকে দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “তিস্তার পানির হিস্যা নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের একটা সমঝোতা হয়েছিলো। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মমতা বাধা হয়ে দাড়ায়।”
এ সংকট নিরসনে আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আশা করি আলোচনার মাধ্যমে একটা সন্তোষজনক ফলাফল আসবে।”
বাংলাদেশ প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদভাব বজায় রেখে চলতে চায় বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি আরো বলেন, “এটি নালিশের কোনো বিষয় না। আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধান হবে।”
গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি বিষয়ে তিনি বলেন, “এ চুক্তির সময় কথা ছিলো দু’দেশের বিনিয়োগের মাধ্যমে ১টা ব্যারেজ নির্মাণ করা হবে। যাতে উভয় দেশ লাভবান হয়। খরচও শেয়ার করার কথা ছিল।”
গঙ্গা চুক্তি নিয়ে আবারো আলোচনা হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নদী পথের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা সড়ক রক্ষা করতে গিয়ে নদীতে বাঁধ দিয়ে কিংবা নদীর গতি পথ পরিবর্তন করে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলেছি।”
সারাদেশে নৌপথ চালু হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন,”আমাদের রেল ও নদী পথ কম খরচের ও সহজলভ্য। অথচ এ দুটোই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। অনেক জায়গায় সড়কের ফুট ব্রিজ রয়েছে। যেগুলোর কারণে নৌকা চলাচল করতে পারে না। নৌকা চলাচলের উপযোগী করতে ব্রিজগুলোর একটা প্যাসেজ ভেঙ্গে উঁচু করা হবে।”
এ লক্ষ্যে ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার কথাও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
নদী ভাঙ্গন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির করতে হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ দেয়া হয়। শুধু বাঁধ দিলে চলবে না। আমরা প্রতি বছর বছর কত বাঁধ নির্মাণ করবো, বাঁধ আর কত উঁচু করবো। দিনে দিনে নদীর নাব্যতা কমে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “শুধু ব্লক বা বালির বস্তা ফেলে ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব নয়। নদী ভাঙ্গন রোধে ডুবোচরগুলোকেও কেটে দেয়া হবে।”
বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পরিকল্পিতভাবে বসতি নির্মাণ করতে সবাইকে অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বন্যার পরের বছর প্রচুর ফসলও হয়। আমাদের বন্যার সঙ্গে বসবাস করতে হবে। কিন্তু তাতে যাতে কোনো প্রাণের ক্ষতি না হয়। আমাদের পরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে তুলতে হবে। খেয়াল করতে হবে বিভিন্ন সময় বন্যায় পানির লেয়ার (স্তর) কতটুকু হয়েছে।”
ভবিষ্যতে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণে ফসলী জমির মাটি ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “নদীর পলি দিয়ে নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।”
যেকোনো মূল্যে দেশের নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
ধান চাষকে দক্ষিণাঞ্চলে নেয়ার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ধান চাষকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নিতে চাই। আর উত্তরাঞ্চলে ভুট্টা, গম, ডাল, তৈল বীজসহ অন্যান্য রবি শস্য চাষ হবে।”
তিনি আরো বলেন, “ধান চাষে বেশি পানি লাগে। উত্তরাঞ্চলে বোরো ধান চাষ করতে মাটির নিচের পানি ব্যবহার করতে হয়। ফলে এখানকার পানির লেয়ার নিচে নেমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। পানির লেয়ার নিচে নেমে গেলে ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়বে। দক্ষিণাঞ্চলে ধান চাষ হলে সারফেস ওয়াটার ব্যবহার করা যাবে।”
ধান চাষকে দক্ষিণাঞ্চলে নিতে লবণাক্ত সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
দক্ষিণাঞ্চলের নদীর নাব্যতা বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মাধ্যমে লবণাক্ততা কমানোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
নদীতে স্লুইসগেট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে নদী ও খালে স্লুইসগেট নির্মাণের কনসেপ্ট বাদ দিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “নদী ও খালে স্লুইসগেট তৈরির ফলে নদী ও খালগুলো মরে যাচ্ছে। আমাদের নদী ও খালগুলোকে রক্ষা করতে হবে।”
সেচের সুবিধার জন্য নদী ও খালের স্বাভাবিক গতিপথ বন্ধ করে স্লুইসগেটের মাধ্যমে জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ রকম কৃত্রিম ব্যবস্থার মধ্যে একটি তিস্তা ব্যারেজ।
স্লুইসগেটের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন,”স্লুইসগেট তৈরি আনন্দের বিষয়। কিন্তু স্লুইসগেট তৈরির পরে এর আর খোঁজ নেওয়া হয় না। গেটের দু’পাশে পলি পড়ে স্লুইসগেটগুলো সিলড হয়ে যায়। এতে স্লুইসগেটগুলো আর কাজে আসে না।”
তিনি আরো বলেন, “জোয়ার ভাটা অঞ্চলে স্লুইসগেট আর কখনো নির্মাণ করা উচিত নয়। স্লুইসগেটের কারণে এসব এলাকার খালগুলো মরে যাচ্ছে।”
এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবদুস সোবহান শিকদার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব আবুল কালাম আজাদ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খানসহ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০টায় এ মন্ত্রণালয়ে এসে পানিসম্পদ মন্ত্রনালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি সর্ম্পকে খোঁজ-খবর নেন প্রধানমন্ত্রী। পরে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে এ মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে মতবিনিময় করেন।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি ও মান বৃদ্ধি করতে ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিদর্শণে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধারাবাহিকভাবে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করছেন।
প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়সহ বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় পরিদর্শণ করেন।