ঢাকা: সংসদে উত্থাপিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাসের ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে। বৈঠকে কে বা কারা কী কারণে বিলটির সমালোচনা করছেন সেদিকে কান না দিয়ে জনগণের সামনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরার জন্য দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই বিলটি যেদিন জাতীয় সংসদে আলোচনা ও পাস করা হবে সেদিন সব সংসদ সদস্যরই উপস্থিত থাকার বিষয়েও আলোচনা হয় বৈঠকে।
রোববার রাতে জাতীয় সংসদ ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে রাত পৌণে আটটায় বৈঠকটি শুরু হয়ে চলে রাত সোয়া নয়টা পর্যন্ত। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও বক্তব্য দেন দলের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আনিসুল হক, আবদুল মতিন খসরু, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, অধ্যাপক আলী আশরাফ প্রমুখ।
সূত্র জানায়, বৈঠকে সংবিধান বিল পাসের সময় কীভাবে বিভক্তি ভোট দিতে হয় সে সম্পর্কেও নতুন সংসদ সদস্যদের অবহিত করা হয়।
বৈঠকে সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামসহ যারা সংশোধনীর বিরোধিতা করছেন তাদের তীব্র সমালোচনা করা হয় বলে সূত্র জানায়।
বৈঠক সূত্র আরো জানা যায়, বৈঠকে দলের সিনিয়র নেতারা বিলটি প্রসঙ্গে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, এ বিলটি নিয়ে বিচারপতিদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। কারও প্রতি আক্রোশ থেকে নয়, বরং গণতন্ত্রকে সুবিন্যস্ত ও সুসংগঠিত করার জন্যই বিলটি আনা হয়েছে। আর এই বিলটি নতুন কিছু নয়। ৭২-এর সংবিধানেও এটি ছিল। পুনরায় সেটি আনার মাধ্যমে ৭২-এর সংবিধানের চেতনায় পুনঃস্থাপন হয়েছে মাত্র। এতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ আরো সমুন্নত হবে।
নেতারা এ প্রসঙ্গে জিয়াউর রহমানের শাসনামলের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ওই সময় প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনকে আদালত থেকে নেমে সরাসরি বাড়ি চলে যেতে হয়েছিল। কেবল কমনওয়েথভূক্ত দেশগুলো নয়, আমাদের পার্শ্ববর্তী ভারতসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতিকেও তাদের সংসদের কাছে জবাবদিহী করতে হয়।
তারা বলেন, সংসদ যেখানে সকল ক্ষমতার উৎস, সেখানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতাও সংসদের হাতে থাকা উচিত।
বৈঠক সূত্র জানায়, এ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী বিলটির ব্যাপারে নানা মহলের সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামসহ যারা বিরোধিতা করছেন, তারা তো ৭২-এর সংবিধানে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদকেই দিয়েছিলেন, বিধানটি রেখেছিলেন। উনারা ১৯৭২ সালে বিধানটি রাখতে পারলে আমরা ২০১৪ সালে এসে তা পুনর্বহাল করতে পারবো না কেন? আসলে তারা বিরোধিতা করছেন যাতে আমরা এটা করতে না পারি। বাস্তবে অনেকেই আছে যাদের আওয়ামী লীগ ও সরকারের কোনো শুভ ও ভালো কাজ পছন্দ হয় না। সবকিছুতেই বিরোধিতা করাই যেন অনেকের কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, যিনি বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনিই আবার আনকনটেস্টে নির্বাচিত কেন অবৈধ হবে না জানতে চেয়ে আদালতে রিট করেন। তারা আজ এমপি হলে এর বিরোধিতা করতো না এটাই বাস্তব কথা।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ খণ্ডন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা জনগণের ম্যান্ডেট (রায়) নিয়ে ক্ষমতায় এসেছি। তাই সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা আমাদের রয়েছে। কে নির্বাচনে এলো, কে এলো না সেটা বিষয় নয়, জনগণ আমাদের ভোট দিয়েছে। জণগণের রায় নিয়েই আমরা ক্ষমতায় এসেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় এমপিদের উদ্দেশে বলেন, রাতের টক শোসহ অনেক জায়গায় অনেকেই বিরোধিতা ও নানান কথা বলবে, কিন্তু আমাদের সবাইকে জনগণের সামনে প্রকৃত সত্যটি তুলে ধরতে হবে। জনগণকে এদের ব্যাপারে সজাগ ও সতর্ক করতে হবে, যাতে দেশবাসী বিভ্রান্ত না হয়। আর বিলটি পাস হলে গণতন্ত্রই বিকশিত হবে।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে চিফ হুইপ আসম ফিরোজ বলেন, সংসদে উত্থাপিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিল পাসের ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বৈঠকে কে বা কারা কী কারণে বিলটির সমালোচনা করছেন সে ব্যাপারে জনগণের সামনে প্রকৃত সত্য তুলে ধরার জন্য দলের সংসদ সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা কী কারণে ও কী প্রেক্ষাপটে বিলটি পাস করছি তা জনগণকে বোঝাতে হবে। যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারকে মাত্র সিঙ্গেল মেজোরিটি (একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা) দিয়ে অভিশংসন করা যায়, সেখানে উত্থাপিত বিলটি পাস হলে বিচারপতিদের অপসারণে দুই-তৃতীয়াংশ মেজোরিটি লাগবে। আগে যেখানে মাত্র তিন জনের সিদ্ধান্তে বিচারপতিদের অপসারণ করা যেত, এখন তা করতে হলে সংসদে ২৩৪ জন সংসদ সদস্যদের সমর্থন প্রয়োজন পড়বে। অর্থাৎ এই বিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের পদকে আরো সম্মানিত করা হয়েছে। গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত ও সুসংহত করা হয়েছে।