বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে হত্যা, নির্যাতন ও গুমের অভিযোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন হেগ-এর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর। তীব্র সমালোচিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর ক্রমবর্ধমান সহিংসতার মধ্যেই ইউরোপীয় মানবাধিকার সংগঠন দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশিন ফর ফ্রিডমস অব রাইটস (আইএফসিআর) গত ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে মামলাটি করে।
সংগঠনটি বলছে, নির্বাচনজনিত সহিংসতায় কত লোক মারা গেছেন তা স্পষ্ট নয়। আওয়ামী লীগ সরকার এর তদন্ত করতে অস্বীকৃতি জানানোয় এখন এ দায়িত্ব পড়েছে আইসিসির ওপর।
আইসিসি প্রসিকিউটরের কাছে পাঠানো অভিযোগের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, ‘সরকার হত্যা, নির্যাতন, গুম, স্বেচ্ছাচারী গ্রেফতার, নিপীড়ন ও অন্যান্য অমানবিক উপায়ে সিসটেম্যাটিক্যালি বিরোধীদের দমন করছে।’
‘ব্যাপকভিত্তিক ও সিসটেম্যাটিক (কৌশলের) অংশ হিসেবে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। কাজেই এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।’
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবকে প্রশিক্ষণ থেকে বাদ দেয়ার জন্য চিঠি দেয়ার পরপরই আইসিসিতে এই আবেদন করা হয়। র্যাব ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশী কর্মকর্তাদের কাছে লেখা এক চিঠিতে মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জন এফ ডনিলোউইজ লিখেছেন, ‘র্যাব সদস্যরা গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকায় তারা যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য।’
তবে র্যাবের মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান এই ঘোষণাকে পাত্তা দেননি। তিনি বলেন, ‘র্যাব সদস্যরা মানসিক ও শারীরিকভাবে যোগ্য। কাজেই তাদের কোনো বিদেশি প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দরকার নেই।’
সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ১৪৬ জন নিহত হয়েছে। ২০১২ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছিল ৭০ জন।
নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, এসব মৃত্যুকে নিরাপত্তা বাহিনী ‘ক্রসফায়ার’ বলে দাবি করলেও নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অনেককে হত্যা করা হয়েছে।
তবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘এই সরকার হত্যা ও গুমের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না।’
আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা
গত ৪ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর ফতো বেনসৌদার কাছে মামলাটি দায়ের করা হয়।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশিন ফর ফ্রিডমস অব রাইটস আল জাজিরাকে জানিয়েছে, তারা বেনসৌদার কাছ থেকে একটি প্রাপ্তি স্বীকারপত্র পেয়েছেন। এখন মামলাটিতে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করবেন কিনা তিনি তা পরীক্ষ-নিরীক্ষা করে দেখবেন।
মামলায় বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী বেআইনি হত্যা ছাড়াও উত্তপ্ত লোহার রড দিয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের নির্যাতন করে। তাদের ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়। আবেদনে নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতার ওপর জোর দেয়া হলেও মানবাধিকার সংগঠনটি বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর থেকেই বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তা বাহিনী অপরাধ সংঘটিত করে আসছে।
মামলায় বলা হয়েছে, ‘এটা স্পষ্ট যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে প্রথম ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শত শত লোককে হত্যা করা হয়েছে।’ যুক্তরাজ্য সংসদের গণহত্যা ও মানবাধিকার বিষয়ক কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান এবং যুদ্ধাপরাধ বিশেষজ্ঞ লর্ড কারলাইল কিউসি বলেন, আবেদনটি তদন্তের দাবি রাখে।
‘আইসিসির কাছে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা গুরুতর এবং গভীর অনুতাপ নিয়ে আমি এই মনোভাব পোষণ করছি যে, বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের এখন আইসিসির বিচারের মুখোমুখি করা উচিত’ যোগ করেন তিনি।
লর্ড কার্লাইল বলেন, ‘আমরা আশা করি, বাংলাদেশের সরকারের দায়ী কর্মকর্তাদের আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দীর্ঘদিন বন্দি রেখে সাজা দিতে হবে।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্তব্য চানতে চাইলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। মামলাটির সর্বশেষ তথ্য সম্পর্কে আইসিসির বক্তব্য জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশিন ফর ফ্রিডমস অব রাইটসের (আইএফসিআর) পক্ষে মামলাটি দায়ের করেছেন ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান। এই সংগঠনটিকে বাংলাদেশী গণমাধ্যমে ইসলামপন্থি মানবাধিকার সংগঠন বলে অভিহিত করা হয়েছে। মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের হোতাদের বিচারের জন্য ২০১৩ সালে সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তার ফেসবুক পেজে অভিযোগ করেছেন, ক্যাডম্যান ‘বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের পক্ষে আইসিসিতে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।’
তবে আল জাজিরাকে ক্যাডম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশ, সিরিয়া ও মিসর ইস্যুতে আমি মামলার সঙ্গে জড়িত আছি। তবে আমি মুসলমানও নই, কিংবা রাজনৈতিকভাবে এসব সংগঠনের সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতাও নেই। আইসিসির মামলাটি সাম্প্রদায়িকতা সংক্রান্ত নয়। এটা হলো রাষ্ট্রের ক্ষমতা অপব্যবহার সংক্রান্ত।’
‘প্রকৃত তথ্য হচ্ছে (মামলায়) ভিকটিমদের যে তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে, তাতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হবে যে এটা কোনো একটি রাজনৈতিক দলের ব্যাপার নয়। বর্তমান সরকার তার শাসনের বিরোধীদের বিরুদ্ধে পুলিশ, আদালত নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করে যে নোংরা যুদ্ধ চালাচ্ছে এটা তার প্রতিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন মামলা’ দাবি করেন তিনি।
ঢাকার মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে জানুয়ারির শুরু থেকে অন্তত ৩০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তেজশ্রী থাপা আল জাজিরাকে বলেন, এসব ঘটনা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ও বিক্ষোভ সংক্রান্ত সহিংসতার প্রতিটি ঘটনার স্বাধীন, বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রয়োজন। গত বছর এতে বহু জীবন ঝরে পড়েছে। এখন পর্যন্ত কাউকেই এজন্য জবাবদিহি করতে হয়নি।’ ‘দায়মুক্তির সংস্কৃতি শেষ করতে হবে এবং এটা সম্ভব শুধু শক্তিশালী স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে’ যোগ করেন থাপা।