প্রখ্যাত সাংবাদিক ও উপস্থাপক। সাংবাদিকতার খ্যাতিতে আড়ালে চলে যায় তার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট
পরিচয়। বহুমাত্রায় খ্যাতিমান শফিক রেহমান বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলক হিসেবেও পরিচিত। তার সম্পাদিত যায়যায়দিন পত্রিকাটি এ দিবসটি জনপ্রিয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিজ বাসায় মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শফিক রেহমান কথা বলেছেন ভালোবাসার আদ্যপান্ত নিয়ে।
১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত লন্ডনে নির্বাসিত থাকার সময় ভালোবাসা দিবস উদযাপন হতে দেখেছেন শফিক রেহমান। তিনি জানান, যদিও আশির দশকের তুলনায় নব্বইয়ের দশকে এটা খুব বেশি উদযাপন হওয়া শুরু হয়। তবে সেটা বাণিজ্যিক কারণে। তবুও স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা এটা সাদরে গ্রহণ করেন। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালোবাসা দিবস শুধু সীমাবদ্ধ ছিল প্রেমিক-প্রেমিকা এবং তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। শফিক রেহমান বলেন, নির্বাসন থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর মনে হলো এটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ, এখানে ভালোবাসার বাণী আছে। তবে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে করা যাবে না। কারণ, ছোটবেলায় আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি এপ্রিল ফুল ডে করতে গেলে বলা হতো এটা খ্রিষ্টানদের জিনিস, মুসলিমবিরোধী। ভয় ছিল আমি কোনো কিছু করতে গেলে আমার বিরুদ্ধে প্রচার হতে পারে আমি ইসলামবিরোধী। সেজন্য সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে নামটা কেটে দিয়ে শুধু ভালোবাসার দিন হিসেবে নাম দিয়েছি। পরবর্তীতে দেখলাম এটা ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হলো। বাঙালি সবকিছুতে আন্তর্জাতিকতা পছন্দ করে বলে এটাকে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বলা শুরু হলো। আমরা বিশ্বখ্যাতি পাওয়ার জন্য কাঙাল। আসলে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বলতে কিছু নেই।
শফিক রেহমান বলেন, আমার পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল এটা শুধু স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। ভাই-বোন, পিতা-মাতা-সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি বলছি, এই দিনে মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাও। অন্তত এক কাপ চা বানিয়ে মাকে খাওয়াও। আমার খুব দুঃখ, আমি আমার মায়ের জন্য কিছু করতে পারিনি। তবে বাংলাদেশে ভালোবাসাটা অনেক বেশি দরকার। কারণ, এখানে জনবসতি অনেক বেশি। সুসম্পর্ক, সহাবস্থান গড়ে ওঠা জরুরি। ভালোবাসার পরিধিটা বৃদ্ধি করতে হবে যেন সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে।
আমি তো একা, তাহলে আমি কীভাবে পালন করবো ভালোবাসা দিবস। সেই চিন্তা থেকে আমি আমার পাঠকদের লেখা পাঠাতে বললাম। তাদের জীবনের গল্প। পাঠকদের এতো লেখা পেয়েছি যে ৬৪ পৃষ্ঠার চারটা বিশেষ সংখ্যা বের করতে হয়েছে। আমি অবাক হয়েছি, আমাদের দেশের মানুষ এত ভালোবাসে। তাইতো জনসংখ্যা এত বেশি। পাঠকের সহযোগিতায় ভালোবাসা দিবসটি আমি ছড়িয়ে দিতে পেরেছি।
শফিক রেহমান বলেন, ভালোবাসা দিবস নিজে স্পেশালি কখনো উদযাপন করিনি। পার্টি, ডিনার, ড্রিংকস এসব কখনো করা হয়নি। ওই দিনটিতে ভালোবাসার বাণী প্রচারে ব্যস্ত থাকি। আমি ভাবিনি এটা এত দূরে যাবে। মানুষ এই দিনটাকে এত সুন্দরভাবে উদযাপন করবে। ভালো লাগে যখন মানুষ এই দিবসকে বিশেষভাবে পালন করে। তবে আমার মনে হয় ভালোবাসার দিনটা একমাত্র প্রোগ্রাম, যেটা সারাবিশ্বে একসঙ্গে উদযাপিত হয়। তবে অনেকেই হয়তো বলে নির্দিষ্ট একদিনেই কেন ভালোবাসার প্রকাশ হতে হবে। এক্ষেত্রে আমি বলবো, প্রতিদিন যদি ‘ভালোবাসি’ বলে তাহলে খুবই ভালো। কিন্তু বাংলাদেশে ভালোবাসার প্রকাশটা অনেক কম। একদিন অন্তত বলুক। ভালোবাসার প্রকাশ হওয়াটা দরকার। ফেসবুকে চুমু খাওয়ার বিষয়ে যে ঝড় উঠেছে, আমি মনে করি চুমু খাওয়া কোনো বাহাদুরি নয়। যারা করেছে একটা ফালতু জিনিস করেছে। ঘোষণা দিয়ে পুলিশের সামনে চুমু খাওয়া, আমাকে টিকিট দিলেও আমি যাবো না।
প্রকৃত ভালোবাসার সংজ্ঞা দেয়া মুশকিল। ভালোবাসা একটা পারস্পরিক আকর্ষণ। যদি এটা পারস্পরিক আকর্ষণ হয়, এটা একতরফা নয়। ভালোবাসা চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। সৌন্দর্য এবং অনুভূতি নির্ভর করে মনের ওপর। তবে আমি মনে করি ভালোবাসা হচ্ছে যে মানুষকে তুমি ভালোবাসবে তাকে কখনো কষ্ট দেয়া যাবে না। এমন কিছু করা যাবে না যেটাতে সে কষ্ট পাবে। মমত্ববোধ এবং শ্রদ্ধবোধের মিশ্রণই হচ্ছে ভালোবাসা। নিজের ভালোবাসার গল্পটা সবসময় এড়িয়ে যাই। কারণ, এখানে আমি জিনিসটা গৌণ। ভালোবাসা বিষয়টা প্রধান। তবে নিজের গল্পটা আমি হয়তো কোনো বইয়ের মাধ্যমে সবাইকে জানাবো।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসার পরিবর্তন হচ্ছে। আমি নিজে যখন বিয়ে করেছি তখন ভালোবেসে বিয়ে করাটা মানুষ ভালো চোখে দেখতো না। অভিভাবকরা ভাবতো নিজেরা দেখে বিয়ে দিলে সেটাই ভালো হবে। কিন্তু এখন চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন হয়েছে। তবে কেউ যদি একই সময়ে একের অধিক মানুষের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে তাহলে আমি বলবো এখানে ভালোবাসা নেই। ভালোবাসার মানুষ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ায় আগে মা-বাবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।
ভালোবাসা দিবসে রাজনীতিবিদদের আমি বলবো হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করুন। গুম, হত্যা, পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। এতে করে প্রতিনিয়ত মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে। রাজনীতিবিদদের এটা বুঝতে হবে সমাজে যদি প্রতিহিংসার রাজনীতি চলে তবে এটা ছড়িয়ে যাবে। কাউকে ফাঁসি দিলেও প্রতিহিংসাটা বেড়ে যায়। ভালোবাসা এবং মৃত্যুদণ্ড দুটা মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বর্তমান তরুণরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে চায় বলে গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তাটা করছে না। তবে আমি বলবো, শেখ হাসিনার গণতন্ত্র সেনাতন্ত্রের চেয়ে ভালো। গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য আমাকে নির্বাসিত হতে হয়েছে।
শফিক রেহমান বলেন, চট্টগ্রামে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম। সেখানে ডিসি হিলের উল্টো দিকে ছোট্ট একটি রাস্তার নাম ছিল লাভ লেন। এই লেনের শুরুতে পানের দোকান ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে এসে পান খেত। পানের আকৃতিও ছিল হার্টের মতো। হয়তো সেই পানের জন্যই রোডটা এত বিখ্যাত ছিল। আমি যখন যায়যায়দিনের প্লট বুকিং দেই তখন সেখানে রাস্তার নাম ছিল না। তখন আমি সে সময়ের নগর পিতাকে বলেছি চট্টগ্রামের মতো এখানে আমি একটা লাভ রোড চাই। কিন্তু আমি চাই বলে রোডের নামকরণ হলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে। তবে যদি এলাকাবাসীর চাওয়ার জন্য এই নামে রোড হয় তাহলে সেটা পরিবর্তন করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে নগর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় জনগণের দাবিতে বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তমদের নামে সড়ক তৈরি করা হবে। তখন লাভ রোড নাম চেঞ্জ করতে হলে অন্য সড়কের নামও পরিবর্তন করতে হবে। তবে এখন সবাই এটাকে লাভ রোড বললেও একটি দৈনিক পত্রিকা এই নাম ব্যবহার করছে না। তাতে আমার কিছু আসে যায় না। ভালোবাসার জয় একদিন হবেই, ওরাও লিখবে।
শফিক রেহমান বলেন, ভালোবাসার রঙ লাল এটা ভাবার কারণ হতে পারে রক্তের রঙ লাল এবং হার্টের রঙও লাল। তবে লাল জিনিসটা মানুষকে আকৃষ্ট করে। অনেক মানুষের সঙ্গে কানেক্ট করার একটা মাধ্যম হচ্ছে লাল। ভালোবাসার দিনের প্রবর্তক হিসেবে আমি বলবো এই দিনটি শুধু স্বামী-স্ত্রী কিংবা প্রেমিক প্রেমিকার জন্য নয়। পুরো পরিবারের জন্য, সব সম্পর্কের জন্য। পশ্চিমাদের কাছ থেকে আমরা যেসব নিবো সেটা কিন্তু নয়। তাদের পরিবার ভেঙে গেছে। কিন্তু আমরা সেটা ধরে রাখতে পেরেছি। এটা ভালো এবং এটাকে টিকিয়ে রাখতে হবে। পরবর্তী প্রজন্ম এই দিনটাকে কীভাবে উদযাপন করবে এটা তারা ঠিক করবে। তবে ভালোবাসার সম্পর্কটা প্রকাশ হতে হবে।