ই-গেটের সুফল নেই, লাইনেই ঘণ্টা পার যাত্রীদের

0

দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ই-পাসপোর্ট চালু করে বাংলাদেশ। এর সুফল নিতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চালু করা হয় ই-গেট। তখন বলা হয়েছিল, স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ করায় দ্রুত সম্পন্ন হবে ইমিগ্রেশন কার্যক্রম। চালুর আট মাস না যেতেই অধিকাংশ সময় ই-গেট বন্ধ থাকে। খোলা থাকলেও ই-গেট পেরিয়ে সেই আগের নিয়মেই যেতে হয় ইমিগ্রেশন ডেস্কে। এতে একসঙ্গে একাধিক ফ্লাইট অবতরণ কিংবা ছাড়ার সময় হলেই দীর্ঘ হচ্ছে লাইন।

সরেজমিনে শাহজালাল বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পার হতে গিয়ে দেখা যায় যাদের ই-পাসপোর্ট আছে, তাদের অনেকেই ই-গেট ব্যবহার করছেন না। আবার যারা ব্যবহার করছেন, তাদের ভিসা যাচাইসহ অন্য কাজে ফের ইমিগ্রেশন ডেস্কে যেতে হচ্ছে। ফলে সময় লাগছে প্রায় আগের মতোই। এছাড়া কারিগরি ত্রুটির কারণে অনেক সময় ই-গেট বন্ধ থাকছে। তখন যাত্রী চাইলেও ই-গেট ব্যবহার করতে পারছেন না। তাই লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েই সব যাত্রীকে সম্পন্ন করতে হচ্ছে ইমিগ্রেশন।

ই-পাসপোর্ট চালুর পর থেকেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ই-গেট স্থাপনের বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পরে ঢাকঢোল পিটিয়ে শাহজালালে স্থাপন করা হয় মোট ২৬টি ই-গেট। এর মধ্যে আগমনীতে ১২টি, বহির্গমনে ১২টি ও ভিআইপিতে দুটি ই-গেট রয়েছে। যাদের ই-পাসপোর্ট রয়েছে, তারা এসব গেট ব্যবহার করে দ্রুত ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার কথা।

কিন্তু ই-পাসপোর্টধারী যাত্রীদের অভিযোগ, ই-গেট চালু হওয়ার আগে ও পরে এর সুবিধা নিয়ে সরকার ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়েছে। বলা হয়েছে অল্প সময়ে কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই যাত্রী ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে পারবেন। এখন দেখা যায় প্রায় সময়ই ই-গেট বন্ধ থাকে। যখন চালু থাকে, তখন অনেকেই এই গেট ব্যবহার বোঝেন না। ফলে যাত্রীরা এর সুফল পাচ্ছেন না। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষও এসব গেট ব্যবহারে যাত্রীদের উৎসাহ দিচ্ছে না।

তবে শাহজালাল বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ ও ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্টরা জানান, তাদের সব ই-গেট সচল। দিনে দুই থেকে তিন হাজার ই-পাসপোর্টধারী যাত্রী এসব গেট ব্যবহার করছেন। এতে যাত্রীরাও সন্তুষ্ট। তবে কারিগরি কোনো কারণে হয়তো কিছু সময়ের জন্য ই-গেট বন্ধ থাকে। অন্যথায় সব সময়ই চালু থাকে ই-গেট। ই-পাসপোর্টধারীদের সহযোগিতা করতে প্রত্যেক গেটে লোক থাকেন বলেও জানান তারা।

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক কামরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, দিনে যত সংখ্যক যাত্রী বিমানবন্দরে যাতায়াত করেন তাদের গড়ে ১৫ শতাংশ ই-পাসপোর্টধারী। তাদের অনেকেই ই-গেট ব্যবহার করতে ভয় পান কিংবা আগ্রহী নন। তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ই-গেট ব্যবহার করেন না। আমরা চেষ্টা করি, ই-পাসপোর্টধারীদের ই-গেট ব্যবহার করাতে। প্রতিটি গেটে আমাদের লোকজনও রয়েছে।

তিনি বলেন, এখন ই-পাসপোর্টের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। একটা সময় মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট বা এমআরপি থাকবে না। তখন সবাই ই-গেট ব্যবহার করবেন বলে আশাকরি।

ইমিগ্রেশন পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, ই-গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শুধু পাসপোর্ট ও যাত্রীকে শনাক্ত করা যায়। কিন্তু স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাত্রীর ভিসা পরীক্ষা করা যায় না। এছাড়া যাত্রী কোথায় যাবে, কোন উড়োজাহাজে ভ্রমণ করবে, ই-গেটে সেই তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ফলে ই-গেট ব্যবহার করলেও আগের মতোই ভিসা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ম্যানুয়ালি। এতে ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হয়। এর মধ্যে কাছাকাছি সময়ে একাধিক ফ্লাইট অবতরণ করলে বা গেলে ইমিগ্রেশনে আরও বেশি চাপ পড়ে। এই চাপ সামলাতে ইমিগ্রেশন পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয়।

শাহজালাল বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ই-পাসপোর্ট ও অটোমেটেড বর্ডার কন্ট্রোল (এবিসি) ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে মোট ৫০টি ইলেকট্রনিক গেট স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে শাহজালাল বিমানবন্দরে ২০২২ সালের জুনে ২৬টি ই-গেট স্থাপন করে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট বিভাগ (ডিআইপি)। এই ই-গেট প্রথমে যাত্রীর পাসপোর্ট পরীক্ষা করে। পাসপোর্ট ঠিক থাকলে প্রথম ব্যারিয়ার খুলে যাবে। এগিয়ে পরের গেটে গেলে সেখানে ক্যামেরায় পাসপোর্টধারীর মুখ ও চোখ স্ক্যান করা হবে। পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে ও যাত্রীর চেহারা মিলে গেলে খুলে যাবে পরের ব্যারিয়ার। ছবি না মিললে বা পাসপোর্ট ভুয়া হলে কিংবা বিদেশ ভ্রমণে সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ব্যারিয়ার খুলবে না। এমন ধারণা থেকে ই-গেট চালু করা হয়, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়ে আসছে।

শুক্রবার (৩ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টায় সরেজমিনে দেখা যায়, শাহজালালের আগমনী ইমিগ্রেশনে সবকটি ই-গেট বন্ধ। যাত্রীদের কাউকে এই গেট ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এসব ই-গেটের মনিটরে লেখা ‘গেট বন্ধ’। কিন্তু কেন বন্ধ, তার কোনো কারণ লেখা নেই। একটি ই-গেট সচল থাকলে সেটিতে এই প্রতিবেদক ই-পাসপোর্ট দিয়ে ইমিগ্রেশন করতে যান। কিন্তু গেট থেকে কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি। গেটের আশপাশে ইমিগ্রেশনের কোনো কর্মকর্তাকেও দেখা যায়নি।

ওইদিন রাত ১১টায় এমিরেট‌স এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজে প্রায় পাঁচ শতাধিক যাত্রী শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন। একই সময় সৌদি এয়ারলাইন্সের আরেকটি ফ্লাইট অবতরণ করে। সব যাত্রী একসঙ্গে আগমনী ইমিগ্রেশনে লাইনে দাঁড়ান। এতে ইমিগ্রেশনে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়। ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করতে সময় লাগে ৪৫ মিনিট বা এর বেশি। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে অন্য যাত্রীদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই থেকে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ইকে-৫৮৪ নম্বর ফ্লাইটে সপরিবারে শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন ফেনীর জামাল হোসেন। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকায় তার ছয় বছরের মেয়েটাও কান্না করছিল।

জামাল হোসেন জাগো নিউজকে জানান, দীর্ঘ এক যুগ ধরে ব্যবসার কাজে তিনি সপরিবারে দুবাই থাকেন। গত বছর ছুটিতে দেশে এসে সবার ই-পাসপোর্ট করিয়েছেন। কিন্তু এখন ই-পাসপোর্ট থাকলেও ই-গেটের সেবা পাচ্ছেন না। সবার সঙ্গে আগের মতোই লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে।

গত ২৯ জানুয়ারি বহির্গমনে ই-গেট ব্যবহার করে দুবাই হয়ে ফ্রান্স যান ঢাকার গুলশানের প্রসাধনী ব্যবসায়ী ইফতেখারুল ইসলাম। তিনি বলেন, যাওয়ার সময় ই-গেটে লাইনে দাঁড়াতে হয়নি। এক মিনিটের কম সময়ে ই-গেট দিয়ে ঢুকতে পারছি। তবে ই-গেট পার হলেও ইমিগ্রেশন ডেস্কে ম্যানুয়ালি কাজের জন্য ফের কিছু সময় দাঁড়াতে হয়েছে। এখন ফেরার সময় দেখি ই-গেটই বন্ধ। লাইনে শত শত যাত্রী দাঁড়িয়ে আছেন।

দীর্ঘ সাত-আট ঘণ্টা জার্নি করে ইমিগ্রেশনে আবার লাইনে দাঁড়ানো খুব বেশি কষ্টের বলে জানান এমআরপি পাসপোর্টধারী সৌদি প্রবাসী রুবেল রানা। তিনি বলেন, ই-গেটগুলো চালু থাকলেও তাদের লাইনে লোকজন কম হতো। এখন সবাই একই লাইনে দাঁড়ান। ইমিগ্রেশন শেষ করতে দেরি হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানবন্দরের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, পাসপোর্ট ও যাত্রী শনাক্তের বিষয়টি আগে ইমিগ্রেশন পুলিশ ম্যানুয়ালি করতো। কিন্তু পুরো ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হলে যাত্রীর ভিসাসহ অন্য তথ্যও যাচাই করতে হয়। সেগুলো যাচাই করতে যাত্রীকে ইমিগ্রেশন ডেস্কে যেতে হবে। সেখানে ভিসা পরীক্ষা করা হয়। এজন্য কিছুটা সময় লাগে।

ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের এসব সমস্যা সমাধানে ইমিগ্রেশন পুলিশের ভূমিকার বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি (ইমিগ্রেশন) জি এম আজিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, যে কোনো নতুন কিছুর সঙ্গে মানুষ খাপ খাওয়াতে কিছুটা সময় নেন। আমরা চেষ্টা করছি, যাদের ই-পাসপোর্ট আছে, সবাই যাতে ই-গেট ব্যবহার করে। আমরা সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছি।

ইমিগ্রেশনে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আজিজুর রহমান বলেন, শাহজালালে ইমিগ্রেশনের পরিধি বাড়ানোর মতো জায়গা নেই। নতুন ডেস্ক বসাতে গেলে প্রচুর জায়গা লাগে। তবে থার্ড টার্মিনালের কাজ শেষ পর্যায়ে। সেটি চালু হলে সেবার মান আরও বাড়ানো হবে।

উৎসঃ   jagonews24
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More