ককপিটে লাইসেন্সহীন বৈমানিক, বাঙ্কে ক্যাপ্টেন, যাত্রীর ‘মৃত্যু’

0

১৬ জানুয়ারি ২০২৩। বাংলাদেশ বিমানের ঢাকা-জেদ্দা রুটের বিজি ৩৩৬ ফ্লাইট। চলন্ত বিমানটিতে ক্যাপ্টেন ছিলেন দিলদার আহমেদ তোফায়েল। আর সেই ফ্লাইটে ছিলেন সিভিল এভিয়েশন থেকে মনোনীত ইন্সপেক্টর তথা পরিদর্শক ফরিদুজ্জামান (লাইসেন্সবিহীন)। পরিদর্শকের কাজ বিমানটির সবকিছু দেখভাল করা। কিন্তু ক্যাপ্টেন তোফায়েল তাকে ককপিটে বসিয়ে রেস্ট বাঙ্কে ঘুমাতে চলে যান। আর তার সঙ্গে রেখে যান প্রশিক্ষণার্থী ক্যাপ্টেন ইরফানুল হককে।

এদিকে জানা গেছে, ফ্লাইটটি যখন বাংলাদেশে ফিরছিল তখন জেদ্দা থেকে আসা কবীর আহমেদ নামে এক যাত্রীর হার্ট অ্যাটাক হয়। তখন সেই বিমানটিতে ছিলেন ডা. হারুন নামের এক চিকিৎসক। তিনি ওই যাত্রীর সেবা-যত্ন করেন এবং তার অবস্থা খারাপ দেখে দ্রুত কাছের কোনো বিমানবন্দরে বিমানটি অবতরণের পরামর্শ দেন। বিমানটি তখন ভারতের আকাশে ছিল এবং কাছের বিমানবন্দর ছিল দিল্লি। কিন্তু ফ্লাইটটি দিল্লিতে অবতরণ না করে সোজা চলে আসে ঢাকায়। কারণ, ওই সময় ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ছিলেন ঘুমে আর ককপিটে ছিলেন ইরফানুল ও সিভিল এভিয়েশনের পরিদর্শক ফরিদুজ্জামান। এতে প্রায় চার শতাধিক যাত্রীর জীবন ছিল ঝুঁকির মুখে। এ ধরনের ফ্লাইটকে অবৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়। যা সিভিল এভিয়েশন আইন ২০১৭ এর ৩৩ এর ধারা অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ।

এ বিষয়ে বিমানটিতে যাত্রী হিসেবে থাকা শমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ডাক্তার হারুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানের ভেতরে হার্ট অ্যাটাক হওয়া যাত্রীকে আমি আমার সর্বোচ্চ সেবা দিই। তার অবস্থা খারাপ দেখে আমি বিমানে দায়িত্বরতদের কাছের কোনো বিমানবন্দরে ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণের পরামর্শ দিই। কিন্তু তারা সেটা না করে সোজা ঢাকায় চলে আসে। এতে যাত্রীর যা ক্ষতি হওয়ার সেটা হয়ে যায়। ফ্লাইটটি যদি দিল্লিতে অবতরণ করানো যেত তাহলে হয়তো ওই যাত্রী বেঁচেও যেতে পারতেন।’

বিমানের যাত্রী কবীর আহমেদের পরিবারের অভিযোগ, ক্যাপ্টেনের অবহেলার কারণে বিমানটি ঢাকায় অবতরণের পর রেমিট্যান্স যোদ্ধা মারা যান। এমনকি প্রবাসীর মারা যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও মিথ্যাচার করেছে বাংলাদেশ বিমান কর্তৃপক্ষ। সারাবাংলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বিমানটিতে দায়িত্ব পালন করা বৈমানিকদের নানা অসঙ্গতি এবং বিমানের মিথ্যাচারের বিষয়টি।

সিভিল এভিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী, লাইসেন্সবিহীন বৈমানিক কখনো পরিদর্শক হতে পারে না। কিন্তু ফরিদুজ্জামানকে পরিদর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ৬৫ বছরের বেশি বয়স হলে কোনো বৈমানিক ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারেন না। তবুও ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক ফরিদুজ্জামান আইন ভঙ্গ করে বিমানের ককপিটে বসে ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ বিমানের ম্যানুয়ালে একজন বিমানের ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব এবং কার্যাবলী সম্পর্কে ও.এম.এ এর প্যারা ২.৩.১.১. এবং ২.৩.১.২ এর প্যারা ২.৩.১.৩.৪.৫.৬.৭.৮ এর এই প্যারাগুলোতে বলা আছে। একই সাথে ২.৩.১.৩ এ বলা আছে, একজন ক্যাপ্টেনকে প্রতিটি ক্রু মেম্বার ও যাত্রীদের ফ্লাইট নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া একজন ক্যাপ্টেনকে সবসময় নিজ আসনে থেকে ফ্লাইটের প্রতিটি বিষয় নির্দিষ্ট সময় পর পর মনিটরিং করতে হবে। অপরদিকে, ২.৩.১.২ এ বলা আছে, একজন ক্যাপ্টেনই ক্ষমতা রাখেন যেকোনো ইমাজের্ন্সি মুহূর্তে বিমানটি যেকোনো দেশের যেকোনো বিমানবন্দরে অবতরণ করানোর।

সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, জেদ্দা থেকে ঢাকার আকাশ পথের দূরত্ব ৫ হাজার ২৩১ কিলোমিটার বা ৩ হাজার ২৫০ মাইল। এই দূরত্ব পাড়ি দিতে সময় লাগে সাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি। বিমানটিতে ৩৫ জন যাত্রী ছিলেন বিজনেস ক্লাসে আর ইকোনকি ক্লাসে ছিলেন ৩৮৪ জন। এছাড়া ক্রু ছিলেন ১০ জন। বিমানটি যখন ভারতের আকাশে প্রবেশ করে তখন বিমানের ক্যাপ্টেন তোফায়েল ক্রু রেস্ট বাংকারে ঘুমাতে চলে যান। আইন অনুযায়ী বিমানে একজন বৈমানিক সবো‍র্চ্চ ৩০ মিনিট কন্ট্রোল রেস্ট নিতে পারেন। কিন্তু সেটা নিতে হবে বৈমানিককে নিজ আসনে বসে। সেক্ষেত্রে শর্ত হলো, ককপিটে জেগে থাকা বৈমানিকের সাথে (পেছনে) অন্য একজন কেবিন ক্রু বসে থাকবেন। তবে অনবোর্ড ইঞ্জিনিয়ার অথবা যদি ইন্সপেক্টর থেকে থাকেন তিনি কোনোভাবেই বৈমানিকের আসনে বসতে পারবেন না।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কোনো ফ্লাইটে যদি রুট চেক চলে তাহলে ক্যাপ্টেন প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিককে রেখে ঘুমানোর জন্য ককপিট ত্যাগ করতে পারেন না। এমনকি আনঅথোরাইজড ব্যক্তি দ্বারা ককপিটের পাইলটের সিট অকুপাইড হওয়ার বিষয়টি লগ বুকে উল্লেখ করেননি ক্যাপ্টেন এবং প্রশিক্ষণার্থী বৈমানিক ক্যাপ্টেন ইরফানও সেফটি রিপোর্টের মাধ্যমে বিষয়টি বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাননি। বিষয়টি তারা দু’জনই চেপে গেছেন। এমনকি এই ঘটনার পর লাইসেন্সবিহীন সাবেক বৈমানিক ফরিদুজ্জামানকে সিভিল এভিয়েশন থেকে সাসপেন্ড না করে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিজি ৩৮৬ ও ৩৮৭ ইনিশিয়াল রুট চেকের জন্য কুয়ালালামপুরে পাঠানো হয়।

অনুসন্ধানে আরও বেরিয়ে এসেছে, বিমানটি হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের পর এম্বুলিফ্ট দিয়ে হার্ট অ্যাটাক হওয়া যাত্রীকে নামানো হয়। বিমানটি ১৬ তারিখ সকালে অবতরণ করলও অসুস্থ যাত্রীকে নামাতে প্রায় ৪৫-৪৬ মিনিট অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। এর পর ওই যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

সিভিল এভিয়েশন আইন ২০১৭ এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো পাইলট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কোনো বিমান বা ভূমি বা পানিতে অবস্থানকারী কোনো ব্যক্তি বা সম্পদের জন্য বিপজ্জনক পদ্ধতিতে বিমান পরিচালনা করেন তাহলে তিনি অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অনধিক ৫ কোটি টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বিমানটির প্রশিক্ষণার্থী ক্যাপ্টেন ইরফানুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘ককপিট ছেড়ে ক্যাপ্টেন চলে যান এবং ফরিদুজ্জামান স্যারকে ককপিটে বসিয়ে দিয়ে যান। আমার আসলে কিছুই করার ছিল না। যখন যাত্রীর হার্ট অ্যাটাক হয় তখন ককপিটে আমি এবং ফরিদুজ্জামান স্যার ছিলাম। আমি ফরিদুজ্জামান স্যারকে বলেছিলাম দিল্লিতে বিমানটি অবতরণ করানোর জন্য। কিন্তু তিনি আমাকে সোজা ঢাকা ল্যান্ড করতে নির্দেশ দেন। আমি সেটাই করেছি। আমি যা বলার বিমানকে বলব। এর বেশি আমি কিছুই বলব না।’

এ বিষয়ে বিমানটির ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করা তোফায়েলকে গত কয়েক দিনে একাধিকবার ফোনে কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে বিমানের ক্যাপ্টেনের অবহেলার কারণে যাত্রী মারা যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বিমানের জিএম (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিমানের অবহেলায় কোনো যাত্রী মারা যায়নি। ১৬ জানুয়ারি সকাল ১১টার পরে বিমানটি নামে। এরপর কবীর আহমেদ নামের ওই যাত্রীকে আমরা সব সেবা দিয়েছি। যাত্রীকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হলে তিনি সুস্থ হয়ে যান। এবং সুস্থ অবস্থায় যাত্রীর ভাইয়ের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে জানতে বিমানের এমডি ও সিইও শফিউল আজিমকে একাধিকবার ফোনে কল দেওয়া হলে তিনিও রিসিভ করেননি। এছাড়া তার ফোনে মেসেজ দেওয়া হলেও তার কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

কবীর আহমেদের ভাই ইসমাইল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা গত ১৬ জানুয়ারি সকাল ১১টার দিকে ভাইয়ের ফোনে কল দিলে বিমানের এক ব্যক্তি রিসিভ করেন এবং ভাই অসুস্থ বলে জানান। এরপর তারা প্রথম আমাদের ভিআইপি গেইটে দাঁড়াতে বলেন। এর পর ফের বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেইটে দাঁড়াতে বলা হয়। তখন আমার ভাইকে মুখে ফেনা ওঠা অবস্থায় দেখতে পাই। এর পর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার ১২টা ৫ মিনিটের দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

তার অভিযোগ, বিমানবন্দর থেকে দ্রুত যদি তার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়া হতো তাহলে তিনি মারা যেতেন না। বিমানও তাদের সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে। তার ভাইয়ের কী হয়েছে তা জানায়নি বিমান কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, অবৈধভাবে ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল এভিয়েশন পরিদর্শক ফরিদুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই বলব না। আপনি নিউজ করলে করেন। আমার কিছুই হবে না।’

এসব বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমানের কাছে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। আইনের ব্যত্যয় হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউই আইনের বাইরে নন। অনিয়ম হলে কিংবা আইন ভঙ্গ হলে আমরা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেব।’

সারাবাংলা

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More