টানা বর্ষণে কক্সবাজার ও বান্দরবানে সৃষ্ট বন্যায় ৩০ জন মারা গেছেন। আর নিখোঁজ রয়েছেন আরও ২ জন।
চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বন্যায় ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৩৭ কোটি টাকার।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, টানা বর্ষণে সৃষ্ট ভয়াবহ বন্যায় চট্টগ্রামে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধসে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ি। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৩৫ কোটি টাকার।
গত ১ আগস্ট থেকে চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাত শুরু হয়। ৪ আগস্ট নগরী ও জেলায় বন্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যে ৭ আগস্ট পর্যন্ত চার দিন টানা জলাবদ্ধতা ছিল নগরীতে। অপরদিকে জেলার ১৫ উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলায় এখনও কিছু কিছু এলাকায় বন্যায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। জেলার সাতকানিয়া, চন্দনাইশ, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি ও হাটহাজারী উপজেলায় এখনও হাজার হাজার বাড়িঘর পানির নিচে ডুবে ছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশ উপজেলায়।
চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ মজুমদার বলেন, ‘বন্যায় চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ১৫ জন পানিতে ভেসে মারা গেছেন। এর মধ্যে সাতকানিয়ায় ছয়, লোহাগাড়ায় চার, চন্দনাইশে দুই, রাউজানে এক, বাঁশখালীতে এক ও মহানগরীতে একজন মারা গেছেন। প্রাথমিকভাবে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩৫ কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘জেলার স›দ্বীপ ছাড়া বাকি ১৪ উপজেলায় কমবেশি বন্যা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী।’
সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন বিশ্বাস বলেন, ‘বন্যায় সাতকানিয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এখন পানি নামছে। অনেক মাটির ও সেমিপাকা ঘর ধসে পড়েছে। রাস্তাঘাট, কৃষি, মৎস্য, গবাদিপশুর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সাতকানিয়ায় এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা যাওয়া ছয় জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত নিখোঁজ আছেন তিন জন। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে আরও কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।’
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শরীফ উল্লাহ বলেন, ‘লোহাগাড়ায় বন্যার পানি অনেকাংশ নেমে গেছে। চার জন মারা গেছেন। তাদের লাশ পাওয়া গেছে। রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি, মৎস্য, সবজি, গবাদিপশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ৩০০-৪০০ মাটির ঘর বন্যায় ভেঙে গেছে। তবে কী পরিমাণ এ বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা তালিকা করা হচ্ছে।’
সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা মিজানুল ইসলাম বলেন, ‘এমন ভয়াবহ বন্যা আগে কখনও দেখিনি। এত পানি কীভাবে এলো তা বুঝতে পারছি না। ১৯৯৭ ও ২০১৯ সালেও দুটি বড় বন্যা হয়েছিল। তখন পানি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত ওঠেনি। বরং অন্য এলাকার লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। এবারের বন্যায় আমার বাড়ির ভেতরেও গলা পানি। তবে গত দুদিন বৃষ্টি না হওয়ায় পানি কমেছে।’
সাতকানিয়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এস ইউনুস বলেন, ‘ভয়াবহ বন্যায় আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ ঘরে পানি ঢুকেছে। কোনও কোনও স্থানে ঘরের চালের ওপর পর্যন্ত পানি উঠেছে। এ কারণে কেউ আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উঠেছে। যারা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যায়নি তারা আশ্রয় কেন্দ্রে এসেছে। বন্যায় ইতোমধ্যে আমার ইউনিয়নে ৩০০টির মতো ঘর ধসে গেছে। এর মধ্যে দুটি সেমিপাকা বাকিগুলো মাটির ঘর। শুধু আমার ইউনিয়নে তিন জন লোক বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গেছে। এর মধ্যে একজনের লাশ উদ্ধার হলেও দুই জনকে এখনও পাওয়া যায়নি। বর্তমানে পানি কমছে। তবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, ১৪টি উপজেলা এবং সিটি করপোরেশনের মধ্যে এক লাখ ৪০ হাজার ১২টি পারিবারের ছয় লাখ ৩৫ হাজার ১৩০ জন লোক বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েন।
এর মধ্যে মীরসরাই উপজেলার চারটি ইউনিয়নের পাঁচ হাজার ৯০ পরিবারের ২০ হাজার ৩৬০ জন, ফটিকছড়ির এক ইউনিয়নের ৯০ পরিবারের ৪৫০ জন, সীতাকুণ্ডে ৯ ইউনিয়নের দুই হাজার ৮৬২ পরিবারের ১৫ হাজার ২৬০ জন, হাটহাজারীতে ১৫ ইউনিয়নের ৫০ হাজার পরিবারের দুই লাখ, রাউজানে ১৪ ইউনিয়নের ১৯ হাজার পরিবারের ৭৫ হাজার, রাঙ্গুনিয়ায় ১৫ ইউনিয়নের ২৫০ পরিবারের এক হাজার ২০০, বোয়ালখালীতে ৬ ইউনিয়নের ৫৫০ পরিবারের দুই হাজার ৭৫০, পটিয়ায় ১৮ ইউনিয়নের ১৬ হাজার ৫৯৫ পরিবারের ৫৩ হাজার ৩১০, কর্ণফুলী উপজেলার ৫ ইউনিয়নের এক হাজার ৮৫০ পরিবারের ৯ হাজার ২৫০, আনোয়ারায় ১১ ইউনিয়নের এক হাজার ৪২৫ পরিবারের ৮ হাজার ৫০, চন্দনাইশে ১০ ইউনিয়নের পাঁচ হাজার পরিবারে ২৫ হাজার, সাতকানিয়ায় ১৭ ইউনিয়নের মধ্যে ২২ হাজার ৫০০ পরিবারে ৯০ হাজার জন, লোহাগাড়ায় ৯ ইউনিয়নের চার হাজার পরিবারের মধ্যে ৮০ হাজার, বাঁশখালীতে ১৫ ইউনিয়নের মধ্যে ১০ হাজার পরিবারের ৫০ হাজার ৫০০ ও সিটি করপোরেশনের মধ্যে ৮০০ পরিবারের চার হাজার জন পানিবন্দি ছিলেন।
কক্সবাজারে ১২ মৃত্যু, ক্ষতি এক কোটি ৪০ লাখ টাকা
কক্সবাজারে পানি কমে বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। এদিকে, গতকাল সকালে পেকুয়া ও চকরিয়ার বিভিন্ন স্থান থেকে পানিতে ভেসে যাওয়া চার জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
জানা গেছে, কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নে চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জেলা প্রশাসনের হিসাব মতে, প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি এক কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের ফেরাংগি পাড়া এলাকা থেকে বন্যার পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ দুই শিশুসহ তিন শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তারা হলো উজানটিয়া ইউনিয়নের নুরুল আলমের মেয়ে তাহিদা বেগম (১০) ও আমির হোসেন (৫) ও একই এলাকার সাবের আহমদের মেয়ে হুমায়রা বেগম (৮)। উদ্ধার হওয়া শিশুরা মঙ্গলবার সকালে মাতামুহুরী নদীর ঢলের পানিতে ভেসে গিয়ে নিখোঁজ ছিল। এ ছাড়া চকরিয়া উপজেলার খুটাখালীত বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া অজ্ঞাত একজনের লাশ লাশ উদ্ধার করেছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেপি দেওয়ান জানান, বন্যার পানি নামতে শুরু করলেও এখনও নি¤œাঞ্চলের বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে পানি রয়েছে। পুরোপুরি নেমে গেলে বন্যার পূর্ণাঙ্গ ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা যাবে।
এদিকে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর চকরিয়ায় ‘বন্যার পানিতে’ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়া সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় এক বাবা ও তার দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। বুধবার রাত ১১টায় চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের বহদ্দারকাটা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান চকরিয়া থানার ওসি জাবেদ মাহমুদ। তারা হলেন চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের বহদ্দারকাটা এলাকার আনোয়ার হোসেনের (৭৮), তার ছেলে শাহাদাত হোসেন (৫০) ও শহীদুল ইসলাম (২২)।
ওসি জাবেদ মাহমুদ জানান, গত কয়েকদিন ধরে ভারী বর্ষণে উজানের ঢলে চকরিয়ার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে চকরিয়া উপজেলার বিএমচর ইউনিয়নের বহদ্দারকাটা এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেনের বসতভিটাও বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। এ ঘটনায় তার বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে পানি ঢুকে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বুধবার রাতে বসতভিটা থেকে পানি নেমে যাওয়ায় আনোয়ার হোসেনের দুই ছেলে পরিষ্কার করতে নামেন। এতে গ্যাসের বিষক্রিয়ায় ট্যাংকের ভেতরে দুই ভাই অবচেতন হয়ে পড়েন। এ সময় উদ্ধার করতে নেমে তাদের বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আজ সকালে আনোয়ারও মারা যায়। এ নিয়ে বন্যায় ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে, আগের পাঁচ দিন ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা কক্সবাজারে পাহাড়ি ঢলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। বুধবার থেকে বৃষ্টি কমায় বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে নিচু এলাকায় অবস্থিত কিছু কিছু বাড়িঘর ও এলাকা ডুবে রয়েছে। দুর্গত এলাকায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছে। ফসলি মাঠ ও সড়ক জনপদ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করেনি। বন্যার পানি অধিকাংশ এলাকার নেমে আসায় দুর্গত মানুষের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সাধারণ) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারে ৬০ ইউনিয়নের চার লাখ ৮০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ভ‚মিধস ও পানিতে ডুবে মারা গেছেন ১২ জন। বন্যাদুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের ৯ লাখ নগদ টাকা ও ৮৩ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি এক কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
উল্লেখ্য, চকরিয়া উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বরইতলী, হারবাং, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, পশ্চিম বড় ভেওলা, চিরিঙ্গা, লক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, ফাসিয়াখালী, চকরিয়া পৌরসভা, পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, রামু উপজেলার গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ার রাজারকুল ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রামে বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে।