রমজানের আগে খেজুরের বাজারে ভিড় থাকে প্রতিবছর। পাইকারি আড়তে ব্যবসায়ীরা ভিড় করেন খেজুর কিনতে। কিন্তু এবারের চিত্র একটু ভিন্ন। ভিড় কম। বেচাকেনাও আগের বছরের তুলনায় কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন বেশ কিছু কারণে এবার বেচাকেনা কম। এর অন্যতম কারণ দাম বৃদ্ধি। বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে এবার আমদানি করা খেজুরের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া অন্যসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ায় খেজুরের ক্রেতা কমে গেছে। কারণ মানুষ আগে জরুরি প্রয়োজনীয় পণ্য কিনছে।
বিজ্ঞাপন
খুচরা বাজারে অতিরিক্ত দাম বাড়ার কারণেও বিক্রি কম হচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পাইকারিতে ১০ কেজির কার্টন প্রতি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। বাদামতলী বাজারের আল আনসর এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বিল্লাল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, গত বছরের তুলনায় খেজুরের দাম অনেক বেড়েছে। দাম বাড়ার কারণে বিক্রির পরিমাণ অর্ধেকে নেমেছে। আগে যারা ১০ কার্টন খেজুর কিনতেন, তারা এখন ৫ কার্টন কিনছেন। কারণ হিসেবে তিনি খেজুরের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কথা জানান। বলেন, গত বছর দশ হাজার টাকা দিয়ে ১০ কার্টন খেজুর কেনা গেলেও সেই টাকা দিয়ে এবার ৬ কার্টনের বেশি কেনা সম্ভব না। এই বাজারে ক্রেতার সংখ্যাও অনেক কমেছে বলে জানান পাইকারি এই বিক্রেতা। তিনি বলেন, সাধারণত রোজার কয়েকদিন আগে বাদামতলী বাজারে ক্রেতাদের জায়গা দেয়া যায় না। কম দামে খেজুর কিনতে এখানে অনেক ক্রেতা আসে। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। সারা দিনে মাত্র কয়েকজন ক্রেতা আসে। তিনি বলেন, এটা মূলত সব জিনিসের দাম বাড়ার প্রভাবে হচ্ছে। কারণ, মানুষকে আগে ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে, শখ করে কিছু খাওয়া তো পরের বিষয়।
একই কথা জানিয়ে এই বাজারের মেসার্স আর জেড এন্টারপ্রাইজের শামিম হোসেন বলেন, সব ধরনের খেজুরের দাম বেড়েছে। কার্টনপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। গত বছরের চেয়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দাম বেড়েছে। এতে বিক্রির পরিমাণও অনেক কমেছে। আগে যারা ৫ কার্টন খেজুর নিতেন, তারা এখন ২ কার্টনের বেশি খেজুর নিচ্ছেন না। অর্ধেক বিক্রি কমে গেছে। রমজানের সময়ই মূলত খেজুরের ব্যবসা ভালো হয়। অন্যান্য সময় তেমন বিক্রি হয় না। বিক্রি কমলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হই।
সোনার বাংলা এন্টারপ্রাইজের আবিদ লিও বলেন, খেজুরের দাম ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। কম দামের জিহাদী খেজুর গত বছর বিক্রি হয়েছিল ৯০০ টাকায়, এই খেজুরের দাম বেড়ে এবার ১৩৫০ থেকে ১৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কার্টন। দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া বড়ই খেজুরের দাম গত বছর ছিল ১৮০০ টাকা, কিছুদিন আগে ছিল ২৩০০ টাকা আর এখন ২৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে এতো দাম বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, আমদানিকারকদের কাছে খেজুর চাইলে পর্যাপ্ত পরিমাণে দিচ্ছে। খেজুরের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু দাম নিচ্ছে বেশি। নগদ টাকা ছাড়া তাদের থেকে কোনো খেজুর পাওয়া যাচ্ছে না।
বাদামতলী বাজারের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ৫ কেজির এক কার্টন মাবরুম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। গত বছর এই খেজুরের দাম ছিল সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৩০০ টাকা। এক কার্টন নাগাল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকায়। গত বছর যা ছিল ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আবার ১০ কেজির দাবাস কার্টন বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকায়। গত বছর দাবাস খেজুরের দাম ছিল ২৪০০ টাকা। দশ কেজির এক কার্টন লুলু খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২৫০০ টাকায়, আগের বছর এই খেজুরের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১৭০০ টাকা। এ ছাড়া ৫ কেজির মরিয়ম বিক্রি হচ্ছে ৪০০০ টাকা, কালনী ২৯০০ থেকে ৩০০০ টাকা, আজুয়া ৩৫০০ টাকা, রাবেয়া ১৫০০ থেকে ১৬০০ টাকা, ৫ কেজির মাসরুর ২২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এসব খেজুরের দাম কার্টনপ্রতি ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
কম দামে খেজুর কিনতে বাদামতলী বাজারে আসা ফরিদ আহমেদ বলেন, ২ দিন পর রোজা শুরু হচ্ছে। রোজার মাসে খেজুর ছাড়া আসলে হয় না। এজন্য এখানে খেজুর কিনতে এসেছি। কিন্তু এসে দেখলাম গত বছরের চেয়ে এবার খেজুরের দাম অনেক বেশি। যে পরিমাণ খেজুর কিনবো ভাবছিলাম সেটি আর কেনা হলো না। আরেক ক্রেতা রাশেদুল ইসলাম বলেন, খেজুর ছাড়া ইফতারি জমে না। প্রতি বছরই এখান থেকে কিছুটা কম দামে খেজুর কিনতে আসি। অন্য বাজারের চেয়ে এখানে কিছুটা হলেও কম পাওয়া যায়। কিন্তু এবার এখানেও খেজুরের দাম অনেক বেশি। এক কার্টন খেজুর কিনতে ৩ হাজার টাকা লাগছে। এই খেজুরই গত বছর ২ হাজার টাকায় কিনেছিলাম।
কনজ্যুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এসএম নাজের হোসাইন মানবজমিনকে বলেন, অতি মুনাফালাভের মানসিকতা থেকে ব্যবসায়ীরা খেজুরের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া খেজুরের দাম এতটা বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত খেজুরের মজুত রয়েছে। তিনি বলেন, অন্যান্য পণ্য বিশেষ করে চাল, ডাল ও তেলের বাজার যেভাবে মনিটরিং করার উদ্যোগ নেয়া হয়, খেজুরের ক্ষেত্রে সেটি দেখা যায় না। এটা ট্যারিফ কমিশনের আওতায় বিশ্লেষণ করা হচ্ছে না, সেই সুযোগটা নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। তিনি আরও বলেন, পার্শ্ববর্তী ভারতে কোনো পণ্যের দাম বাড়লে মানুষ সেই পণ্য কেনা কমিয়ে দেয়। ফলে তার দাম কমে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশে কোনো জিনিসের দাম বাড়লে মানুষ সেই জিনিস আরও বেশি করে কেনে। এতে জিনিসের দাম আরও বাড়তে থাকে। এই অভ্যাসটা পরিবর্তন করা দরকার। এটা করা গেলে মুনাফালোভীরা সুবিধা করতে পারবে না।