সংঘাতমুক্ত পরিবেশে ইউপি নির্বাচন করতে নানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট করতে তারা সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করবে শিগগিরই। আগামী মাসের প্রথম সপ্তায় এ বৈঠক হতে পারে। এ বৈঠকে ইসি বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানের কাছ থেকে পরামর্শও গ্রহণ করবে তারা। কত ধাপে ভোটগ্রহণ করলে সরকার ভোট কেন্দ্রে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারবে তারও পরামর্শ নেবে ইসি। প্রতি কেন্দ্রে কতজন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য থাকলে ভোটগ্রহণ নির্বিঘœ হবে তাও তারা জানতে চাইবে নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। অপরদিকে সরকারও চায়, ইউপি নির্বাচন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ করে তৃণমূলে জনপ্রিয়তা বাড়াতে। এ লক্ষ্যে তারা ইসিকে সব ধরনের সহযোগিতা করতে পদ্ধপরিকর বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। সরকারের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, একজন সাব ইন্সপেক্টরসহ চার থেকে পাঁচ পুলিশ সদস্য, ৪ ব্যাটালিয়ান সদস্য ও ১০ থেকে ১৫ আনসার সদস্যের পক্ষে একটি ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে প্রতি কেন্দ্রে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতির ওপর তারা সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন। দেশে প্রথমবারে মতো ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় কর্মকর্তারা এখনো বুঝে পাচ্ছেন না ভোট কেন্দ্রে ও প্রচারণায় কতটা উত্তেজনা থাকবে। তবে তারা মনে করছে আগের চেয়ে উত্তেজনা কম হবে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা মনে করেন, ইউপি নির্বাচনের আগে উত্তেজনা হতো স্থানীয় প্রভাবশালীদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক আদর্শ নিয়ে নয়। এছাড়া মিছিল ও সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলে সংঘর্ষ কমে আসবে। প্রার্থী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে তার প্রার্থিতা চলে যাবে এমন বিধানও সংঘাতমুক্ত নির্বাচনে সহায়ক হবে বলে মনে করেন সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি মিজানুর রহমান। তিনি মানবকণ্ঠকে বলেন, নির্বাচন কমিশন যেভাবে নির্দেশনা দেবেন আমরা সেভাবেই নির্বাচন করব। তবে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে পুলিশের পক্ষে থেকে বিভিন্ন পরামর্শ থাকবে।
অপরদিকে, ভোটকেন্দ্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চায় সরকারও। নির্বাচন কমিশনকে এ লক্ষ্যে করতে চায় পূর্ণ সহযোগিতা। পুলিশের পাশাপাশি আনসার ব্যাটালিয়ন ও বিজিবি নিয়োগ করতে চায় নির্বাচনের দিন। প্রতি কেন্দ্রে দিতে চায় একজন করে ম্যাজিস্ট্রেট। সরকারের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মনে করেন, আগামী মার্চে অনুষ্ঠেয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন তিন থেকে চার পর্যায়ে করলে শান্তিপূর্ণ এবং সংঘাতমুক্ত হবে। প্রতি কেন্দ্রে মোতায়েন করা সম্ভব হবে একজন করে কর্মকর্তাসহ চার পুলিশ, চার ব্যাটালিয়ন ও ১৪ থেকে ১৫ আনসার সদস্য। এর বাইরে বিজিবি থাকবে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। কোনো কেন্দ্রে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটলে তারা সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যাবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করবে। ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে আরো বেশি নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত করার পরামর্শ দেবে সরকার।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন মানবকণ্ঠকে বলেন, একজন অফিসার ও তিন থেকে চারজন পুলিশ সদস্য একটি সাধারণ কেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে ভোট কেন্দ্রের বাইরে ১০-১২ জন আনসার থাকতে হবে। বিজিবিকে থাকতে হবে পজিশন নিয়ে ভ্রাম্যমাণ। এতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ভালো কাজ হয়। তিনি বলেন, এবার দলীয়ভাবে ইউপি নির্বাচন হওয়ায় অতীতের চেয়ে বেশি সংঘর্ষ হওয়ায় আশঙ্কা করছি আমরা। তবে প্রার্থীরা মিছিল এবং সভা সমাবশে না করতে পারলে সংঘর্ষের ঘটনা কমে আসবে।
সূত্র জানায়, আগামী মার্চ থেকে জুন মাসের মধ্যে সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইউপি নির্বচানের প্রস্তুতি জানতে চাইলে এক নির্বাচন কমিশনার বলেন, ইসি সচিবালয়কে ইউপি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলা হয়েছে। মেয়াদ পূর্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে কবে, কোথায় ভোট করা যাবেÑ এ সংক্রান্ত তালিকা আমাদের কাছে আসবে। সব কিছু বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেব। তিনি জানান, হালনাগাদ ভোটার তালিকায় প্রায় ৪৪ লাখ নতুন ভোটার যোগ হচ্ছে, যা চূড়ান্ত হবে ৩১ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারিতে এসএসসি পরীক্ষা রয়েছে। এ সময়ে কোনোভাবেই সাধারণ নির্বাচন করা যাবে না। এপ্রিল মাসে শুরু হবে এইচএসসি পরীক্ষা। তাই পরীক্ষার ফাঁকে উপযুক্ত সময় কখন পাওয়া যাবে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা পাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগের মতো দুই ধাপে ভোট করা হবে, নাকি আরো বেশি ধাপে যেতে হবে তা পর্যালোচনা করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে সব মিলিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়েছে মোট আটবার (১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩, ১৯৮৮, ১৯৯২, ১৯৯৭, ২০০৩ এবং ২০১১)। সর্বশেষ ২০১১ সালে প্রথম দফায় ২৯ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল প্রায় ৬০০ ইউপিতে ভোট হয়। দ্বিতীয় দফায় ৩১ মে থেকে ৫ জুলাই ৩ হাজার ৮০০ ইউপির নির্বাচন করা হয়। ওই তফসিলে প্রথমধাপে মনোনয়ন দাখিল, বাছাই ও প্রত্যাহারের সময় উল্লেখ করে ভোটের জন্য সম্ভাব্য ৬টি দিন ঠিক করে দিয়েছিল কমিশন। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত সমন্বয় কমিটি এর মধ্যে একটি দিন ঠিক করে তা ইসিকে অবহিত করেছিল। পরে ওই তারিখেই হয়েছিল ভোট। এবারো একই পদ্ধতি অবলম্বন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কমিশনের কর্মকর্তারা।
সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব শরীফা আহমেদ সম্প্রতি নির্বাচন উপযোগী ৪ হাজার ৫৪৪টি (তেজগাঁও সার্কেল ছাড়া) ইউনিয়ন পরিষদের তালিকা ইসি সচিবের কাছে পাঠিয়েছেন। তাতে প্রতিটি ইউপির সর্বশেষ ভোটের তারিখ ও মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। ভোট আয়োজনের জন্য তালিকা পাঠিয়ে ইসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও অনুরোধ করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এরপরই ইউপি নির্বাচন নিয়ে তোড়জোড় শুরু করে কমিশন। পৌর নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এরই মধ্যে বিধিমালা সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ইসি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মার্চেই প্রথম দফা ভোট করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো হচ্ছে। মার্চের শেষ ভাগে উপকূলীয় ইউপিগুলোর নির্বাচন সম্পন্ন করা হতে পারে। পরের ধাপে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ভোট হবে বাকিগুলোর।