রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর একটি ফ্ল্যাটে জন্মদিনের দাওয়াতে গিয়ে খুন হন পুলিশ কর্মকর্তা মামুন এমরান খান। গুম করতে লাশ গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় গাজীপুরের এক জঙ্গলে। সেখানে লাশে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় খুনিরা। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। পুরো ঘটনাই ফাঁস হয়ে যায়। ধরা পড়ে খুনি দলের অন্যতম সদস্য রহমত উল্লাহ। পুলিশ তার কাছ থেকে খুনের আদ্যোপান্ত জানতে পারে। খুনি দলের অপর আটজনের মধ্যে তিনজন নারীও ছিলেন। তিন নারীর একজন দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা রবিউল ওরফে আরাভ খানের স্ত্রী। পরিদর্শক মামুন এমরান খান ছিলেন পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ট্রেনিং স্কুলের কর্মকর্তা। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ ছিলেন মামুন। পরদিন সবুজবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার ভাই। এরপর তদন্তে নেমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করে। এদের মধ্যে রহমত উল্লাহ ছিলেন। নিখোঁজের দুই দিন পর গাজীপুরের কালীগঞ্জের একটি জঙ্গল থেকে উদ্ধার হয় মামুনের লাশ। এরপর বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান। মামুনের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, তাদের গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জের রাজরামপুরে। মামুনের বাবা মৃত আজহার আলী খান। মামুন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নেন। ২০০৫ সালে এসআই হিসেবে পুলিশে যোগ দেন। তিনি শান্তিরক্ষা মিশনেও কাজ করেছেন। অবিবাহিত মামুন বড় ভাইয়ের সঙ্গে সবুজবাগে থাকতেন।
চাকরির পাশাপাশি নাটকেও অভিনয় করতেন। ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ এ হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেন ডিবির খিলগাঁও জোনাল টিমের তৎকালীন পরিদর্শক শেখ মাহাবুবুর রহমান। চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয় মামুনের বন্ধু রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাচান ওরফে দিলু শেখ, আলোচিত রবিউল ওরফে আরাভ খান ও তার স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার ওরফে কেয়া এবং সারোয়ার হোসেনকে। শুরু থেকেই পলাতক ছিলেন আরাভ খান। ডিবির তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সবুজবাগ থানায় জিডি হওয়ার পরই পুলিশ প্রযুক্তির সহায়তায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই রহমত উল্লাহকে আটক করে। তার দেওয়া তথ্যে স্বপন সরকার, দিদার পাঠান, মিজান শেখ, আতিক হাচান ওরফে দিলু শেখ, রবিউল ওরফে আরাভ খানের স্ত্রী সুরাইয়া আক্তার ওরফে কেয়া এবং সারোয়ার হোসেন, মেহেরুন নেছা স্বর্ণা ওরফে আফরিন ওরফে আন্নাফী, ফারিয়া বিনতে মীম ওরফে ফারিয়া আক্তার মীম ওরফে মাইশাকে গ্রেফতার করা হয়। রহমত ও মামুন ক্রাইম ফিকশন অনুষ্ঠানে অভিনয় করতেন। সেই সুবাদে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব। মেহেরুন নেছা স্বর্ণা ওরফে আন্নাফীও ক্রাইম ফিকশনে অভিনয় করতেন। সে সময় রহমতের সঙ্গে আন্নাফীরও পরিচয় হয়। এরপর মাঝে মাঝে মোবাইল ফোনে ও ফেসবুকে কথা হতো তাদের। আন্নাফী মোবাইল ফোনে রহমতকে বনানীতে তার বান্ধবীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানের কথা বলে দাওয়াত দেন। রহমত তার সঙ্গে মামুনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান। মামুন ২০১৮ সালের ৮ জুলাই রাত ৮টা ২০ মিনিটে মোটরসাইকেলে করে বনানীর ২ নম্বর রোডের ৫ নম্বর বাড়ির সামনের রাস্তায় যান। সেখানে রহমতের সঙ্গে তার দেখা হয়। প্রায় ২০ মিনিট পর সেখানে আন্নাফী, কেয়া ও মীম উপস্থিত হন। এ সময় রহমতের সঙ্গে কেয়া ও মীমকে পরিচয় করে দেন আন্নাফী।
পরে রহমত বন্ধু বলে মামুনকেও তাদের সঙ্গে পরিচয় করে দেন। ওই সময় রবিউল ওরফে আরাভ একটু দূর থেকে তাদের দেখছিলেন। কেয়া, মীম, রহমত ও মামুনকে সঙ্গে নিয়ে ৫ নম্বর বাড়ির ২/এর ফ্ল্যাটে যান আন্নাফী। বাসায় প্রবেশ করে তারা একটি রুমে যান। কোনো কিছু না দেখে রহমত আন্নাফীকে উদ্দেশ্য করে বলেন- ‘তোমাদের নাকি বার্থ ডে পার্টি। তারতো কিছু দেখছি না?’ তখন কেয়া বলেন- ‘এভাবে আমাদের প্রতিদিন এখানে বার্থ ডে পার্টি হয়। একটু পরেই দেখতে পাবেন।’ পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আগে থেকেই বাসার আরেকটি রুমে ঘাপটি মেরে ছিলেন দিদার, আতিক, স্বপন, মিজান ও সারোয়ার। কিছুক্ষণ পরই দিদার, আতিক, স্বপন, মিজান ও সারোয়ার একসঙ্গে এসে আন্নাফী, কেয়া ও মীমদের বলেন- তোরা কারা? এখানে কেন এসেছিস? এ পরিস্থিতি দেখে মামুন তাদের বলেন- আপনারা কারা? তখন দিদার, আতিক, স্বপন, মিজান ও সারোয়ার নিজেদের প্রশাসনের লোক বলে দাবি করেন। এরপর মামুন নিজেকে পুলিশ কর্মকর্তা বলে পরিচয় দেন। এটি জানার পর তারা মামুনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা মামুনকে এলোপাতাড়ি কিল-ঘুসি মারতে থাকেন। তাদের সঙ্গে রহমত উল্লাহও যোগ দেন। মেয়েদের সঙ্গে উলঙ্গ ছবি তুলতে স্কচটেপ দিয়ে মামুনের হাত-পা বেঁধে ফেলে। উদ্দেশ্য ছিল ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করবেন। গামছা দিয়ে মামুনের মুখও বাঁধা হয়।
সামনে ও পেছন দিক থেকে তাকে মারতে থাকেন মিজান, দিদার ও আতিক। বেধড়ক মারপিটে এক পর্যায়ে মামুন অজ্ঞান হয়ে যান। রাত ১০টায় কেয়া, আন্নাফী ও মীম বাসা থেকে বের হয়ে নিচে চলে যান। ভোরে তারা নিশ্চিত হন যে- মামুন মারা গেছেন। এরপর রহমত উল্লাহ বলেন- লাশ গুম না করলে তারা সবাই বিপদে পড়ে যাবেন। তখন স্বপন বিষয়টি রবিউল ওরফে আরাভকে ফোনে জানান। দিদার ফোন করে রবিউল ওরফে আরাভকে বড় একটি ট্রলি কিংবা বস্তা আনতে বলেন। পরদিন সকাল সাড়ে ৬টায় রবিউল ওরফে আরাভ খান দুটি বস্তা ও সাদা একটি কাপড় নিয়ে আসেন। বস্তায় লাশ ভরে ঢাকা মেট্রো-গ-২৭-৩১৫১ নম্বর গাড়ির ব্যাক ডালাতে তোলেন। এরপর গাড়ি নিয়ে তারা গাজীপুরের দিকে রওনা হন। রবিউল ওরফে আরাভ খান মোটরসাইকেলে করে কেয়া, আন্নাফী ও মীমকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরা পর্যন্ত গাড়ির সঙ্গে যান। গাজীপুর চৌরাস্তা হয়ে শিমুলতলা থেকে মিরেরবাজার ঘুরে উলুখোলা থেকে আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে একটি জঙ্গলে গাড়ি থামায়। এ সময় গাড়ির বনাট তারা খুলে রাখেন। যেন মনে হয় গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছে। এরপর লাশ বাঁশঝাড়ের ভিতরে নিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
bdPratidin