দেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে শীত শেষ হতে না হতেই শুরু হয়ে গেছে ঝড়। সমুদ্রের তর্জন-গর্জন এতটা না থাকলেও প্রতিটি ঘরেই জোরে বইছে বাতাস। তবে এজন্য কোনো মহাবিপদ সঙ্কেত নেই; বরং এই ঝড়ো হাওয়া বয়ে দিয়ে যাচ্ছে আনন্দ বার্তা। আগামী মাসেই (মার্চ) উপকূলের প্রায় ৭ শতাধিক ইউনিয়নে শুরু হচ্ছে চেয়ারম্যান, মেম্বার পদে ভোট। মোট পাঁচ ধাপে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে দেশব্যাপী অনুষ্ঠেয় এই নির্বাচনের প্রথম ধাপটি শুরু হচ্ছে এখান থেকেই। যে কারণে উপকূলীয় এলাকাগুলো এখন সরগরম।
এদিকে তৃণমূলের এই নির্বাচনটিকে ঘিরে এরইমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা অন্যতম বড় দল বিএনপি এই নির্বাচন দিয়েই জাতীয় নির্বাচনের মহড়ায় নামছে। দশম জাতীয় সংসদ এরই মধ্যে দুই বছর পার করে ফেলেছে। ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা ঢাকার বিভক্ত (উত্তর ও দক্ষিণ) দুই সিটিসহ দেশের নির্বাচন উপযোগী সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ এবং পৌরসভায় নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনই আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বড় আকারের নির্বাচন। ফলে এই নির্বাচনটি দুটি দলের কাছেই অনেকটা চ্যালেঞ্জের হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রথমবারের মতো সংসদের প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টিও নিজ নিজ অবস্থান ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এটিকে জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার একটি উত্তম মাধ্যম হিসেবেও সদ্ব্যবহার করতে চাচ্ছেন সবাই। সম্প্রতি শেষ হওয়া পৌরনির্বাচনসহ আগের নির্বাচনগুলোর আয়োজন নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়া নির্বাচন কমিশনও (ইসি) এর মাধ্যমে নিজেদের হারানো ইমেজ ফিরিয়ে আনার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য ইতিমধ্যেই ব্যাপক কর্মযজ্ঞ হাতে নিয়েছে কমিশন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটাধিকার হারানো তৃণমূলের জনগণও এ নির্বাচনটিকে ঘিরে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছেন। দলীয় মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করা হলেও নিজ নিজ দলের সমর্থক নেতাদের বিজয়ী করে আনতে এ নির্বাচনটিকেই টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখছেন তারা। সব মিলিয়ে আসন্ন এ নির্বাচন জনগণের অংশগ্রহণে একটি উৎসবমুখর নির্বাচন হতে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার দুই বছরেরও বেশি সময় পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ইউনিয়ন পরিষদের এই নির্বাচনকে ঘিরে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনী আবহ তৈরি হচ্ছে। আনন্দবঞ্চিত জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি উৎসব আনন্দ করে অনেকটা ‘দুধের স্বাদ ঘোলে’ মেটানোর মতোই জাতীয় নির্বাচনের খেদ ভুলে থাকারও সুযোগ পাচ্ছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন নির্বাচনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার মধ্যদিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং সরকার ৫ জানুয়ারি নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্ন মুছে দিতে চাইবে। সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্ভব। এজন্য এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে সরকার। এমনকি কোনো কোনো ইউপিতে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত দুর্বল প্রার্থীও দিতে পারে। যাতে দশম সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে উত্থাপিত প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। অন্যদিকে সম্প্রতি শেষ হওয়া পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের স্মরণকালের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন বিএনপিকে তাদের পূর্বের দাবি তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে আরো গ্রহণযোগ্য করে দিয়েছে। নির্বাচনের আগেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হওয়া এবং ভোটের দিন শক্তিশালী কোনো প্রতিপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও সারাদেশে ভোট-কারচুপি হয়েছে বলে সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, যা দলীয় সরকারের অধীন সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই জনগণের কাছাকাছি গিয়ে তাদের সরকারবিমুখ করার সুযোগ এ নির্বাচনের মাধ্যমেই নিতে চায় বিএনপি।
এদিকে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে তৃণমূলের রাজনীতি। জাতীয় নির্বাচনে ভোটের উৎসব না হওয়ায় উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে ভোট উৎসব হবে বলে মনে করছেন তৃণমূলের ভোটাররা। তফসিল ঘোষণা হলেও ইতিমধ্যে উপকূলের ৭ শতাধিক ইউপিতে নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সর্বত্র নির্বাচনী আমেজ বইছে। প্রার্থীরা জনসংযোগ শুরু করেছেন। ভোটারের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর তৃণমূলের নেতাকর্মীদেরও মধ্যে চলছে জোর আলোচনা। এতে প্রার্থীদের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচারণায় সরগরম হয়ে উঠছে গ্রামীণ জনপদ। ভোটারদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য।
নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী সপ্তাহেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে। প্রথম ধাপে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ভোটগ্রহণ হবে। আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে দেশের সাড়ে চার হাজারেরও বেশি ইউপিতে নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। বেশ কয়েকটি ধাপে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর তৃণমূলের এই নির্বাচনের মাধ্যমেই ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালানো হবে ইসির ভাবমূর্তি।
Next Post