বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমপক্ষে আটটি দেশের রাষ্ট্রদূত বৃহস্পতিবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে বৈঠক করেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অ্যাম্বাসেডর ছাড়াও ফ্রান্স, ইতালি, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস এই সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূত মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে অংশ নেন।
পরে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী জানান যে, এই রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তার সাথে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয়ের কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
যার মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, আগামী সংসদ নির্বাচন, ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট, অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন অ্যাক্ট এবং সুশীল সমাজ।
মন্ত্রী বলেন, “এই সব নিয়ে তাদের সাথে বিশদভাবে আলোচনা হয়েছে এবং এই আলোচনায় তারা যেসব প্রশ্ন করেছিল, আমি বলেছি (উত্তর দিয়েছি)।”
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট
বাংলাদেশে ব্যাপক বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পাস করা হয়েছিল ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। এই আইনটি কার্যকর করার পর থেকে গত কয়েক বছরে আইনটি দেশে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করেছে বলে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বেগ জানিয়ে আসছেন।
আইনটি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাও বিভিন্ন সময় আপত্তি তুলেছে।
তথ্য ও মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন আর্টিক্যাল নাইনটিন এর আগে জানিয়েছিল যে, ২০২১ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে তার ৪০ শতাংশই হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটুক্তি করার কারণে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেছেন যে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করার জন্য এটি নিয়ে নানা ধরনের প্রোপাগাণ্ডা প্রচার করা হয়।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, “আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সাইবার ক্রাইম বন্ধের জন্য করা হয়েছে এবং সাইবার ক্রাইম বন্ধ করার জন্য এই আইন থাকবে।”
তবে সব দিক পর্যালোচনা করে যদি মনে হয় যে এই আইনে কোন বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, তাহলে তা সংশোধন বা বিধিতে পরিবর্তন করার দরকার হলে সেটি করতেও সরকার রাজি আছে, জানান তিনি।
এই আইনটি ভিন্নমত দমনে ব্যবহার করা হচ্ছে অভিযোগ তুলে এটি বাতিল ও সংস্কারের পক্ষে শুরু থেকেই নানা দাবি ছিলো। তবে এমন অভিযোগ বরাবরই সরকার অস্বীকার করে আসছে।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিষয়ে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান মন্ত্রী।
তিনি বলেন যে এ বিষয়ে তারা জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস থেকে একটি নোট পেয়েছেন যা নিয়ে এখন পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বিষয়টি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের জানানো হয়েছে এবং আলোচনার বিষয়ে তারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বলেও মন্ত্রী সাংবাদিকদের জানান।
আনিসুল হক বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে আগামী ১৪ই মার্চ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আইনমন্ত্রীর বৈঠক রয়েছে। ওই বৈঠকে তিনি এই আইনটি নিয়ে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের আপত্তির বিষয়গুলো তিনি শুনবেন।
আগামী নির্বাচন
সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও যে সাতটি দেশের রাষ্ট্রদূত তার সাথে বৈঠক করেছেন তারা সবাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলাপ করেছেন।
তারা নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চান বলে জানিয়েছেন।
এবিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোন আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।
আইনমন্ত্রী বলেন, “নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি পাঠানোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কোন আপত্তি নেই।”
“এখন পর্যবেক্ষকদের আনার বিষয়টি নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের উপর। তারা ঠিক করবে যে আসলে কতজন পর্যবেক্ষককে আনা হবে।”
আগামী বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে মাত্র ২০ জনের মতো বিদেশি পর্যবেক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ওই নির্বাচনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কোন পর্যবেক্ষক পাঠাতে রাজি হয়নি।
তারা বলেছিল যে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না এবং তারা এই নির্বাচন বা ফলাফল নিয়েও কোন মন্তব্য করবে না।
তবে পর্যবেক্ষক হিসেবে না হলেও নির্বাচনের দিন ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তারা নির্বাচনের দিকে নজর রেখেছিলেন বলে জানানো হয়।
সেসময় দেশীয় পর্যবেক্ষরা অভিযোগ তুলেছিলেন যে, সব কিছু মিলিয়ে তাদের মনে হচ্ছে যেন নির্বাচন কমিশন তাদের পর্যবেক্ষণে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে।
আর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি বিবৃতিতে জানিয়েছিল, বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তারা নির্বাচন পর্যাবেক্ষণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিদেশিদের সংখ্যা ছিলো মাত্র চারজন, যে নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। আর দেশীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন আট হাজারের বেশি।
নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণের বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সরকার চায়। এতে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে কোন বাধা নেই। তবে কোন রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না সেটি সেই রাজনৈতিক দলের নিজস্ব সিদ্ধান্তের বিষয় বলেও জানান আইনমন্ত্রী।
সরকারের উপর বিদেশিদের কোন চাপ নেই উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, তার সরকার কোন হত্যা বা মিথ্যার রাজনীতি করে না, তাই এ বিষয়ে জানাতে সরকারের কোন আপত্তি নাই।
তবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং এর স্বাধীনতা ও সার্বভৌম বিষয়ে কেউ কথা বললে সরকার শুনবে না এবং এদেশের জনগণের জন্য যা ভাল হয় সেটাই করা হবে।
ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট
সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতেরা ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট বিষয়েও বৈঠকে জানতে চেয়েছেন যে এটি আসলে কোন পর্যায়ে রয়েছে।
আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই বিষয়টি নিয়ে এরইমধ্যে স্টেকহোল্ডার (অংশীদারদের) সাথে একবার আলোচনা হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো একবার আলোচনা করা হবে।
“তারা আরো কথা বলতে চায়, আমরা আরো কথা শুনতে রাজি আছি।”
এরইমধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সাথে কথা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন যে তারা আরেকটি বৈঠক করতে আগ্রহী।
রাষ্ট্রদূতেরা জানতে চেয়েছিলেন, এই বিলটি নিয়ে যে অংশীদারদের সাথে আলোচনা হবে সেখানে আন্তর্জাতিক কোম্পানির প্রতিনিধিরা থাকতে পারবেন কি না।
এ বিষয়ে মন্ত্রী জানান, এই আলোচনায় বিদেশি কোম্পানির প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকায় কোন বাধা নেই।
জরিপ, গবেষণা বা বিভিন্ন ধরনের সেবা দেয়ার সময় মানুষের যেসব ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে, সেসব তথ্য বা উপাত্তের সুরক্ষা দিতে সরকার নতুন এই আইন প্রস্তাব করেছে।
কিন্তু এরইমধ্যে দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠান বা নাগরিক নতুন এই আইনের প্রস্তাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
দুর্নীতিবিরোধী গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি বলছে, যেভাবে এই উপাত্ত সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে, তা ঝুঁকিপূর্ণ – কারণ সেখানে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে।
একই রকম উদ্বেগ জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও।
এই আইন পাস করা হলে বিদেশি অনেক কোম্পানিকে ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে হবে বলেও বিভিন্ন সময় আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, একটি বিষয় পরিষ্কার করতে হবে। ডেটা প্রটেকশন অ্যাক্ট আসলে ডেটা নিয়ন্ত্রণের জন্য করা হচ্ছে না, ডেটা বা তথ্য সুরক্ষার জন্য করা হচ্ছে।