যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেও মাঝে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর মতো কিছু বিষয়ে দু’দেশের মাঝে কিছুটা টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়েছে।
তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে সম্প্রতি নতুন উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে ওয়াশিংটনের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা সফর করেছেন।
কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুনভাবে এই আগ্রহের কারণ কী? এ বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে কথা বলেছে বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার।
দৈনিক নয়া দিগন্তের পাঠকদের জন্য সেই সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো :
দ্য ডেইলি স্টার : যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন, সরকারের সাথে কথা বলেছেন। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছি যে ঢাকার ব্যাপারে ওয়াশিংটন নতুনভাবে আগ্রহী হচ্ছে। ওয়াশিংটনের আগ্রহের কারণ কী? কোথায় আকর্ষণ?
পিটার হাস : আমি এটিকে নতুন আগ্রহ বলব না। আমি বরং এটিকে গভীর আগ্রহ হিসেবে অভিহিত করতে চাই, যেটা আমরা কোভিডের সময়টায় দেখাতে পারিনি। এটা ঠিক যে নতুন করে সম্পৃক্ততা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমাদের আগ্রহের জায়গাটি কিন্তু আগের মতোই আছে। আমার মনে হয়, আমাদের একসাথে কাজ করার যে বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে, এটি তারই একটি অংশ।
সেটি হতে পারে মানবাধিকারের প্রশ্নে, বাণিজ্য, নিরাপত্তা, কোভিড সহায়তা, রোহিঙ্গা সংকট, শিক্ষার্থীদের নেয়া- বাংলাদেশের সাথে আমাদের কাজ করার হাজারো বিষয় রয়েছে। যেহেতু এখন সহজেই ভ্রমণ করা যাচ্ছে, তাই তাদের এখানে আসায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ডেইলি স্টার : আপনি বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে তাগিদ দিয়ে আসছেন, কারণ গণতন্ত্র বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। কিন্তু বিএনপি বলছে যে তারা বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে না। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। আওয়ামী লীগ আবার সম্পূর্ণ বিপরীত কথা বলছে। আপনার মূল্যায়ন কি বলে যে নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হবে?
পিটার হাস : আমি প্রথমেই বলতে চাই, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্যদের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে আমি খুশি হয়েছি। তারা বলছেন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। তবে আমি মনে করি, এ ক্ষেত্রে আমাদের জাতিসঙ্ঘের কিছু দলিলের দিকে তাকাতে হবে। কারণ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আছে, যেখানে সদস্য দেশগুলোর সম্মতি আছে।
কিছু বিষয় আছে, যেমন রাজনৈতিক সংগঠন করার স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করার স্বাধীনতা, চলাচলের স্বাধীনতা, তথ্যের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং বলপ্রয়োগ বা সহিংসতার শিকার না হওয়া।
আমি মনে করি, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হওয়ার বিষয়টিকে এসব মানদণ্ডের নিরিখে যাচাই করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা দলীয় সরকারের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা নেই, এমনকি মতামতও নেই। আমরা চাই, নির্বাচনের এই পূর্বশর্তগুলো যেন থাকে, যাতে সব দল মনে করে যে তারা ন্যায্যভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে এবং যদি বাংলাদেশের মানুষ চায়, তাহলে জেতার সুযোগ পাবে।
ডেইলি স্টার : গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেট একটি ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাস করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সমর্থন দেয়া এই অ্যাক্টের উদ্দেশ্য। আবার এই আশঙ্কাও আছে যে যুক্তরাষ্ট্র যখন জাতীয় ঐক্য সরকার এবং গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াইরত জাতিসত্তাসহ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোকে সমর্থন দেবে, তখন চীন ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো হস্তক্ষেপ করবে এবং জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থন আরো বাড়াবে। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারসহ এই অঞ্চলে বড় ধরনের ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। ওয়াশিংটন আসলে এই অ্যাক্ট দিয়ে কী করতে চায়? এই আশঙ্কার বিষয়ে আপনার ভাবনা কী?
পিটার হাস : আমার মনে হয় বার্মা অ্যাক্টের মূল বিষয়বস্তু ও এর উদ্দেশ্য নিয়ে গোড়াতেই ভুল ধারণা আছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছি যে আমাদের লক্ষ্য হলো বার্মায় (মিয়ানমার) গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা এবং সেইসাথে রোহিঙ্গাদের পূর্ণ মর্যাদা ও অধিকারের সাথে, স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। এই লক্ষ্যকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই বার্মা অ্যাক্ট করা হয়েছে।
বার্মা অ্যাক্টের মূল অংশগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সামরিক জান্তা এবং তাদের অস্ত্র ও সমর্থনদানকারীদের ওপরে নিষেধাজ্ঞা বাড়ানো। এর আরেকটি অংশ আছে। সেটি হলো- আপনি যেটি উল্লেখ করলেন- বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা দেয়া। কিন্তু আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সহায়তা হবে শুধুই মানবিক। কোনোভাবেই সামরিক সহায়তা দেয়ার জন্য এটি তৈরি করা হয়নি।
তাই আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশ ও জাতিসঙ্ঘের যে উদ্দেশ্য, বার্মা অ্যাক্টটি ঠিক তাই। উদ্দেশ্যটি হলো গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তন এবং এর ফলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা।
ডেইলি স্টার : রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কোনো সময়সীমা অনুমান করছেন?
পিটার হাস : এটা আসলে পুরোপুরি নির্ভর করছে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের ওপর। আমরা তাদের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছি। তারা যা করেছে, সেটিকে আমরা গণহত্যা ঘোষণা করেছি। আমরা জাতিসঙ্ঘ, আসিয়ান, বিশ্ব-সম্প্রদায়ের সাথে তাদের ওপর চাপ বাড়াতে কাজ করছি।
এর মধ্যেই আমরা বাংলাদেশকে সহায়তার চেষ্টা করছি। গণহত্যা থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা মানুষদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়া থেকে শুরু করে এখানে তাদের ব্যবস্থাপনা এবং তাদের প্রত্যাবাসন- দুই দিকেই আমরা কাজ করছি, যেন তারা এখানে টিকে থাকতে পারে এবং ফিরে যেতে পারে।
ডেইলি স্টার : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ আরো অন্যান্য কারণে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা আসা কমে গেছে। এত কম সহায়তা দিয়ে তারা কীভাবে টিকে থাকবে? এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
পিটার হাস : এটা একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি। এটা শরণার্থীদের কষ্ট আরো বাড়ায় এবং শরণার্থী শিবিরগুলোকে আরো অস্থিতিশীল করে তোলে। আমি মনে করি, এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। একটি বিষয় হলো, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়, এমন দেশের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এটা ঠিক যে আমরা অনেকে সহায়তা কমিয়েছি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অনেক দেশ সহায়তা দিচ্ছে না। তারা হয়তো সহায়তা দেয়া শুরু করতে পারে।
অন্য বিষয়টি হচ্ছে, শরণার্থী শিবির বিষয়ক নীতিমালাগুলোকে খতিয়ে দেখা। বর্তমানে শরণার্থীদের কাজ করার অনুমতি নেই। তাদের আয়ের স্বীকৃত উৎস নেই। ফলে তারা সম্পূর্ণভাবে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। তারা আয় করার অনুমতি পেলে, যে পরিমাণ সহায়তা কমে গেছে সেটার কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবে।
একইভাবে, কিছু আশ্রয় শিবিরকে আরো টেকসই করা গেলে অগ্নিদুর্ঘটনার পর সবকিছু নতুন করে তৈরি করার প্রয়োজন কমে আসবে। সহায়তা কমে যাওয়ার সমস্যা সামাল দিতে তাই অনেক কিছুই করা যেতে পারে।
ডেইলি স্টার : বাংলাদেশ সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আসে। কিন্তু আপনারা বলেছেন যে এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আবার অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়ানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রযুক্তি হস্তান্তর- এসবের জন্য বাংলাদেশের অনেক অর্থ প্রয়োজন। কিন্তু আমরা দেখছি যে এই অর্থ প্রকৃতপক্ষে আসছে না। এই বিষয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
পিটার হাস : আপনি যেমন বললেন, বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। আমি চাই আমাদের এই অবস্থান অব্যাহত থাকুক এবং আরো ভালো হোক। এর একটা বড় অংশ ছিল জ্বালানিখাত এবং জ্বালানিখাতে বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে। এই খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগের চাহিদা আছে, আবার বেশ ভালো পরিমাণে অনাবিষ্কৃত সম্পদও আছে।
এ ছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অন্যান্য খাতে সম্ভাবনা বিবেচনা করছে। মূল বিষয় হলো, বাংলাদেশের অনেক সুবিধা আছে। এখানে বড় একটা বাজার আছে যেটা দ্রুত বড় হচ্ছে, বড় মধ্যবিত্ত শ্রেণি আছে এবং প্রচুর পরিশ্রমী মানুষ আছে। তাই আমেরিকান কোম্পানিগুলো এদিকে দৃষ্টি দেবে।
কিন্তু একইসাথে তারা এই অঞ্চলে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোর দিকেও দৃষ্টি দেবে। কাজেই এখানকার পরিবেশ খুব ভালো হলেও প্রতিবেশী কোনো দেশের পরিবেশ যদি আরো খানিকটা ভালো হয়, বিনিয়োগ তখন অন্য জায়গায় চলে যাবে।
আমি জানি, যেসব বিষয় বিনিয়োগকারীদের দূরে ঠেলে দেয়, সেরকম কিছু বিষয় নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। যেমন: দুর্নীতি, দ্রুত বিচার না পাওয়া, চুক্তি বাস্তবায়নে সমস্যা এবং দেশ থেকে বাইরে ও বাইরে থেকে দেশে অর্থ লেনদেনে সমস্যা। বাংলাদেশ যদি এসব বিষয়ে সংস্কার অব্যাহত রাখে, আমি মনে করি যুক্তরাষ্ট্রের আরো বেশি কোম্পানি এখানে দৃষ্টি দেবে, যার মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিও রয়েছে।
ডেইলি স্টার : বাংলাদেশ সম্প্রতি ইন্দো-প্যাসিফিক নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে এটি করা হচ্ছে, যখন অনেক দেশেরই নিজ নিজ ইন্দো-প্যাসিফিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আপনাদেরও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত পরিকল্পনা আছে। এটি এমন একটি অঞ্চল, যেখানে এখন সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ। আবার এখানে অন্যান্য আরো জোট আছে, যেমন: কোয়াড, অকাস। বাংলাদেশ এমন কিছুতে জড়িত হতে চায় না, যেখানে নিরাপত্তার বিষয়টি আছে। এ ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন?
পিটার হাস : আমার মনে হয় এখানে বোঝার ভুল আছে। প্রথমত, এই জোটগুলো গতানুগতিক সামরিক জোট নয়। কোয়াড কোনো জোট নয়। এটি অনেকগুলো বিষয়ে চারটি দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা- জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, অবকাঠামো, কোভিড।
একইভাবে, আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত পরিকল্পনা এমন বিষয় নয়, যেখানে অন্যরা অংশ নিতে পারে। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত পরিকল্পনার কোনো সদস্যপদ নেই। এটা আইডিয়ার ব্যাপার। আর এই অঞ্চল নিয়ে আমাদের যে পাঁচটি আইডিয়া বা ভাবনা আছে, সেগুলো হলো- এটি হবে অবাধ, সমৃদ্ধ, সুসম্পর্কপূর্ণ ও নিরাপদ। কাজেই পাঁচটি লক্ষ্যের মধ্যে মাত্র একটি নিরাপত্তা সংক্রান্ত, যে বিষয়টি আপনি বলছেন।
আমরা আমাদের মনোযোগ এই অঞ্চলে কিভাবে দিতে চাই এবং কীসে আমরা গুরুত্ব দেবো- তা ঠিক করার এটি একটি প্রয়াস। কেউ পক্ষ অবলম্বন করুক, সেজন্য এটা নয়। আমরা ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনায় যুক্ত হতে কাউকে জোর করছি না। এটা আমাদের দর্শন।
সত্যি বলতে, কয়েক বছর আগে শেখ হাসিনা যখন প্যারিসে গিয়েছিলেন, তখন তিনি একটি প্রাথমিক ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনা দিয়েছিলেন, আমরা যা বলছি সেটি তার কাছাকাছি।