দিনের শুরু শিশুদের হৈ-হুল্লোড়ে। মেলার ষষ্ঠ দিনও ছিল শিশুপ্রহর। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অমর একুশে গ্রন্থমেলা শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। কোমলমতি শিশুদের উচ্ছ্বাসে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও একাডেমি চত্বর।
শনিবার দুপুর গড়িয়ে বিকেলের আঙিনায় যখন গ্রন্থমেলা। শিশুপ্রহর কেটে গেছে। তখনো কাটেনি প্রাণের উচ্ছ্বাস। ছুটির দিনে দুপুরের পর থেকেই জমে উঠেছে প্রাণের মেলা। দর্শনার্থী আর পাঠকের পদচারণায় গতকাল তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না প্রাণের মেলায়।
মেলায় প্রবেশের দীর্ঘ লাইন। সময় গড়িয়ে লাইনের দীর্ঘতা বাড়ছে। তবুও যেন ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে না কারো। লাইনে দাঁড়িয়ে উল্লাস প্রকাশ করছেন বইপ্রেমীরা। এ উল্লাস যেন প্রাণে প্রাণ মেলানোর। যেন নতুন বইয়ের গন্ধে বিভোর হওয়ার।
শিশুপ্রহর আর ছুটির দিন থাকায় গতকালও মেলায় দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড় ছিল। বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিশু-কিশোরসহ সব বয়সের পাঠকদের পদচারণা লক্ষ্য করা যায়। আয়োজকরা জানান, শিশুদের মানসিক বিকাশ ও সব কিছুতে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বাঙালির প্রাণের মেলা ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’য় শিশুদের জন্য রাখা হয়েছে বিনোদনেরও ব্যবস্থা।
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, শিশুপ্রহরে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা শিশুরা শিক্ষক কিংবা পরিবারের সদস্যের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খুঁজে নিচ্ছে তাদের পছন্দের বই। কিনছে কার্টুন। অপরদিকে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেলার বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখছেন সারাদিন ধরে। কিনে নিচ্ছেন পছন্দের বই।
গত চারদিনের তুলনায় শুক্রবার ও শনিবার বইয়ের বেচাকেনাও হচ্ছে বেশ। শিশু কর্নারে প্রগতি প্রকাশনীর আসরার মাসুদ বলেন, চারদিন পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে মেলায় প্রাণ এসেছে। মেলা আজ দুদিন ধরে সত্যিকার অর্থে জমে উঠেছে। শিশুপ্রহর আর ছুটির দিন থাকায় মেলায় দর্শনার্থীর উপচে পড়া ভিড় ছিল লক্ষণীয়।
নতুন বই : একাডেমির তথ্যানুযায়ী, গতকাল মেলায় নতুন ১৫৫টি বই এসেছে। এরমধ্যে গল্প ৩০, উপন্যাস ২৫, প্রবন্ধ ৯, কবিতা ৩৮, গবেষণা ১, ছড়া ৮, শিশুসাহিত্য ৭, মুক্তিযুদ্ধ ২, বিজ্ঞান ৮, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ৩, কম্পিউটার ১, ধর্মীয় ২, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ১ এবং অন্যান্য বিষয়ে ১৭টি।
মাহবুবুল হক শাকিলের কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন: অন্বেষা প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী, কবি মাহবুবুল হক শাকিলের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘মন খারাপের গাড়ি’। গতকাল শনিবার মেলার ষষ্ঠ দিন বিকেলে বাংলা একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে এটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, অধ্যাপক ফকরুল আলম, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ও কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক। নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঞ্চালনায় আরো ছিলেন অন্বেষা প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী শাহাদাৎ হোসেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘এটা খুব আনন্দের কথা যে প্রতি বছর শাকিলের কবিতার বই বের হচ্ছে। তার কবিতায় আমরা আনন্দের খোরাক পাচ্ছি। তার কবিতার গাড়ি চলতে থাকুক তার যেন কোনো ইস্টিশন না থাকে।’
অনুভূতি প্রকাশে কবি মাহবুবুল হক শাকিল বলেন, ‘আমি কবিতা লিখি না আসলে। কবিতার মধ্যে নিজের সঙ্গেই কথা বলেছি। এক সময় মনে হয়েছে এগুলো প্রকাশ করার দরকার আছে। সে আবেগ থেকেই বই প্রকাশ। আমার ব্যক্তিগত চিন্তা অন্যের ভালো লাগলেই বই প্রকাশ সার্থকতায় রূপ নেবে।’
শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা: বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে গতকাল শনিবার অনুষ্ঠিত হয় শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার প্রাথমিক বাছাই পর্ব। প্রতিযোগিতায় বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন খায়রুল আলম সবুজ, অধ্যাপক মোহাম্মদ সেলিম এবং অপরেশ কুমার ব্যানার্জী। শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় ১৪৯ জন এবং উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় ৬০ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন।
মূল মঞ্চের আয়োজন: বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: ফোকলোর কর্মসূচি, অতীত থেকে বর্তমান শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. ফিরোজ মাহমুদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ভারতের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক অসীমানন্দ গঙ্গোপাধ্যায়, শাহিদা খাতুন, নন্দলাল শর্মা এবং সাইফুদ্দীন চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান।
আলোচকরা বলেন, বাংলা একাডেমি ফোকলোর কর্মসূচিতে নিবিড় গবেষণা এবং অব্যাহত ফিল্ডওয়ার্ক উভয়কে সমান গুরুত্ব দিয়ে আসছে। বিগত ষাট বছরে একাডেমি দেশে ও বিদেশে একটি প্রশিক্ষিত ফোকলোর প্রজন্ম তৈরি করেছে। এ প্রতিষ্ঠান থেকে ফোকলোর বিষয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাতশ’ মানসম্পন্ন বই ও সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলা অঞ্চলে ফোকলোর চর্চার ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তাঁরা বলেন, পরিবর্তনমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এখন প্রয়োজন বাংলা একাডেমির আওতায় একটি স্বতন্ত্র ফোকলোর ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা।
অসীম সাহার পরিচালনায় সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘সহজিয়া’-এর শিল্পীরা। সংগীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী বারী সিদ্দিকী, আকরামুল ইসলাম, দিল আফরোজ রেবা, চন্দনা মজুমদার এবং আবদুল হালিম খান। যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন পিনু সেন দাস (তবলা), হাসান আলী (বাঁশি), বিশ্বজিৎ সেন (মন্দিরা), দশরথ দাস (ঢোল), নির্মল কুমার দাস (দোতারা)।
আজকের আয়োজন: আজ বিকেল ৪টায় গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘বাংলা একাডেমির হীরকজয়ন্তী: অনুবাদ কার্যক্রম, অতীত থেকে বর্তমান’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন বিশিষ্ট অনুবাদক অধ্যাপক আবদুস সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন ড. নিয়াজ জামান, অধ্যাপক কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. ফকরুল আলম এবং আবদুল্লাহ আল মামুন। সভাপতিত্ব করবেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সন্ধ্যায় রয়েছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
Next Post