বাসাবাড়িতে গ্যাসের পাইপলাইনে অথবা চুলার লাইনে বিস্ফোরণের কারণে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। গত ছয় মাসে রাজধানী ছাড়াও বিভিন্ন এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে অনেক। কিন্তু কেন ঘটছে এ ধরনের ঘটনা, কীভাবে এই অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং এ জন্য আসলে কারা দায়ী সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি এ পর্যন্ত।
দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগী ও গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো একে অপরকে দোষারোপ করছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, পাইপলাইনে ছিদ্র থেকে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো বলছে, সচেতনতার অভাবে এবং অদক্ষ মিস্ত্রি দিয়ে চুলা ঠিক করানোর ফলেই এই দুর্ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ শনিবার রাতে রাজধানীর গ্রিনরোডের একটি বাসায় গ্যাসের চুলার লাইনে বিস্ফোরণে শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন দগ্ধ হয়েছে। দগ্ধরা হলেন ওয়ান ব্যাংকের কর্মকর্তা আরমানুজ্জামান চৌধুরী, তার স্ত্রী আফরোজা পারভিন এবং তাদের পাঁচ বছরের ছেলে ত্রিমান। আরমানুজ্জামান জানান, রাত নয়টার দিকে তারা বাসার ডাইনিং রুমে রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তখন তার স্ত্রী রান্নাঘরে বৈদ্যুতিক সুইচ অন করলে রান্নাঘরের গ্যাসলাইনে লিকেজ থাকায় বিস্ফোরণ ঘটে আগুন ধরে যায়। ওই সময় স্ত্রীকে বাঁচাতে গেলে তিনিও দগ্ধ হন। তাদের এ অবস্থা দেখে ত্রিমান দৌড়ে ধরতে গেলে সেও দগ্ধ হয়। পরে বাসার অন্যরা তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় ক্লিনিকে নেন। সেখান থেকে ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
পত্রিকার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত বছর এ ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিট এসেছেন কমপক্ষে ২০ জন। এর মধ্যে ৩ জন মারা যান।
গত বছরের ১৮ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানার তল্লা এলাকায় একটি বাড়িতে গ্যাসের পাইপলাইন বিস্ফোরিত হয়ে একই পরিবারের চারজনসহ পাঁচজন দগ্ধ হন। পাঁচজনের মধ্যে একজন রিমন জানান, তারা তখন ঘুমাচ্ছিলেন। দিনে ঠিকমতো গ্যাস পাওয়া যায় না বলে ভোরে উঠে রান্নাবান্নার কাজ করতে হয়। রান্নার কাজ করতে গিয়ে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে ১২ অক্টোবর দক্ষিণ খানের পূর্ব আশকোনায় অগ্নিদগ্ধ হন একই পরিবারের ৫ জন। এর মধ্যে দু’জন মারা যান। দগ্ধ রেজোয়ান আহমেদ শুভ জানান, সকালে গৃহকর্মী সখিনা বাসায় এসে রান্নাঘরে চুলো ধরাতে গেলে গ্যাস সংযোগের পাইপ বিস্ফোরিত হয়ে আগুন ফ্ল্যাটের পাঁচ কক্ষের তিন কক্ষেই ছড়িয়ে পড়ে। এতে ঘরের সবাই দগ্ধ হন। ৪ অক্টোবর ভুগর্ভস্থ গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে দগ্ধ হন তিনজন। রাজধানীর সেনপাড়া পর্বতা এলাকার একটি বস্তিতে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগীদের একজন অভিযোগ করেন, একে তো পুরনো গ্যাসের লাইন, তারপর বস্তিতে অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে এসব পাইপের কেউ দেখভাল করে না।
রাজধানীর ডেমরার সারুলিয়ায় ১৮ আগস্ট গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে এক শিশু মারা যায় এবং এক শিশু দগ্ধ হয়। একই দিনে মিরপুরে একটি ওষুধের কারখানায় বিস্ফোরণে চারজন দগ্ধ হন।
পহেলা জুন, রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভূগর্ভস্থ গ্যাসলাইন বিস্ফোরণে নারী ও শিশুসহ একই পরিবারের সাতজন দগ্ধ হয়েছিলেন। কলাবাগানের মতোই জুরাইনেও মার্চ মাসে ভূগর্ভস্থ গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে একই পরিবারের ৩ জন দগ্ধ হন। এসব ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করান প্রতিবেশীরা।
কলাবাগানের ভূ-গর্ভস্থ গ্যাস লাইন বিস্ফোরণের ঘটনার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, ধারণা করা হচ্ছে, গ্যাসের রাইজারের পাইপ ছিদ্র হয়ে ওই ঘরে গ্যাস জমা হয়েছিল। আগুন জ্বালাতেই সেখানে বিস্ফোরণ ঘটে।
এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে নতুন স্থাপিত গ্যাসলাইন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে ৪০ বছরের পুরনো গ্যাসলাইনও। ইচ্ছে থাকলেও পুরনো এসব গ্যাসলাইনের সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশাদ ইসলাম মানবকণ্ঠকে বলেন, তিতাসের পুরনো পাইপলাইন আছে এটা ঠিক। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে ওয়াসা কাজ করার সময় তিতাসের পাইপলাইন অনেক সময় ক্ষতিগ্রস্ত করে। সেখান থেকেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া বাসাবাড়িতে সাধারণত গ্যাসের পাইপলাইন ও চুলা মেরামত করা হয় অদক্ষ মিস্ত্রি দিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা কিছু না জেনেই মেরামতের কাজ করে। এক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তো থেকেই যায়। সমাধানের বিষয়ে তিনি বলেন, পুরনো পাইপলাইন সংস্কার করা এবং নতুন এলাকায় নতুন পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করছে তিতাস। এছাড়া আবাসিকে পাইপলাইন ও চুলা মেরামতের ক্ষেত্রে তিতাসের লাইসেন্সপ্রাপ্ত মিস্ত্রি দিয়ে কাজ করানোর পরামর্শ দেন তিনি।
এদিকে এ ধরনের দুর্ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা এলাকা পরিদর্শন করেন, নানা রকম উপদেশ দেন। কিন্তু কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে উতরে ওঠা যায় সে বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেন না। তারা জনসচেতনতাকে দায়ী করে নিজেদের দায় সারছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত সতর্কতার অভাব, গ্যাসের চুলার কারিগরি ত্রুটি, বাসাবাড়ির গ্যাসলাইনে যথাযথ প্রযুক্তি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা ইত্যাদি কারণে বড় ধরনের দুর্ঘটনার ঝুঁকি বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে। এছাড়া অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার সময় পেশাদারির সঙ্গে প্রযুক্তি স্থাপনের পরিবর্তে অনভিজ্ঞ মিস্ত্রিদের দিয়ে তা করানোর ফলেও দুর্ঘটনার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। ভূগর্ভস্থ বিভিন্ন সেবা ব্যবস্থার অবকাঠামোগত কাজ করার সময় গ্যাস পাইপলাইনের সুরক্ষার কথাটি ভাবা হয় না এবং এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। জ্বালানি গ্যাস অতিমাত্রায় দাহ্য পদার্থ, এর সরবরাহ ব্যবস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
Prev Post