আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ২০১৩ সালের এপ্রিলে একটি সম্পাদকীয় কলাম লিখেছিলেন-‘সংস্কৃতির লড়াই শিরোনামে’। তিনি সম্পাদকী মন্তব্য কলামের মাধ্যমে বুঝাতে চেয়েছিলেন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানচিত্রের মানুষ একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে রয়েছে।
বর্তমান ভারতীয় তাবেদার সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপুমনির নেতৃত্বে সংস্কৃতির এই লড়াইয়ে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কতটা এগিয়ে গেছে তার একটি ক্ষুদ্র নমুনা হচ্ছে এবারের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তক। ২০২৩ সালের সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান বইটির দিকেই একটু নজর দেওয়া যাক। কোমলমতি একটি কিশোরের মনে কি ঢুকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা অনুমান করা যায় বইটির পাতায় চোখ বুলালে। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এই ভূখণ্ডে যে ধর্মীয় সংস্কৃতি মানুষ ধারণ করছে সেটার কোন অস্তিত্ব সপ্তম শ্রেণীর এই পাঠ্য বইটিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। বইটি পড়লে একজন কিশোর ছাত্রের ধারণা হবে তারা সবাই আগে হিন্দু ছিল এবং হিন্দু সংস্কৃতি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ এবং সভ্য জাতি। বইটির বিভিন্ন অধ্যায়ের মাধ্যমে বুঝানো হয়েছে যে, আমাদের সংস্কৃতি বলতে সম্পূর্ণ হিন্দু সংস্কৃতিকেই বুঝায়। কিন্তু ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ যে ধর্মীয় সংস্কৃতি লালন করছে সেটা কিছু বিদেশীরা এসে জোর-জবরদস্তি করে চাপিয়ে দিয়ে গেছেন।
বইটির কাভার পেজ থেকে শুরু করে মোট ১৯৪ টি ছবি আছে তার তার মধ্যে সকল ছবি মন্দির এবং হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য সংক্রান্ত। এই ভূখণ্ডে মুসলমান ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতির কোন চিহ্ন কোথাও আছে বা ছিল এমন কোন চিহ্ন বইটিতে নেই। ১৯৪টি ছবির মধ্যে ১২৪ এবং ২৫ পাতায় মাত্র মসজিদের দুটি ছবি আছে। কাভার পেজ করা হয়েছে মন্দিরের ছবি দিয়ে।
আমার দেশ পাঠকদের জন্য বইটির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জঘন্যতম ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
কাভার পেজ:
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠই শুধু নয়, হাজার বছর ধরে ৯০ শতাংশ মানুষের জীবনাচার চলছে মুসলিম সংস্কৃতিকে ধারণ করে। অথচ এই দেশের পাঠ্য বইয়ের কভার পেইজটি তৈরি করা হয়েছে পুরাতন মন্দিরের নকশার ছবি দিয়ে। সাধারণত একটি শিশুর সুপ্ত প্রতিভা ও বোধশক্তির বিকাশের প্রকৃত ধারাই সৃষ্টি হয় এই বয়স থেকে। আর এমন বয়সকে টার্গেট করেই ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার ভারতীয় তাঁবেদারির সুযোগে স্কুলের পাঠ্য বইয়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতের সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ।
দ্বিতীয় কাভার পেজ:
এই পেজে গেলে দেখতে পাবেন যে ইন্দিরা গান্ধীর একটি বড় ছবি। তাঁর সাথে রয়েছে আরো কিছু ভারতীয় নাগরিকের ছবি। এই পৃষ্ঠার নিচে লেখা রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধু। অথচ এটা তো সবারই জানা যে, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্মমতার সাথে অন্যান্য মুসলিমদের জড়ানোর মাধ্যমে মুসলিমদের মধ্যে পারস্পরিক বিভেদের বীজ হিন্দুত্ববাদীরা বছরের পর বছর বুনে চলছে।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের অনেক মুসলিম বুদ্ধিজীবী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি শেখ হাসিনা তাদেরকে সম্মাননাও দিয়েছেন। কিন্তু, এই বইয়ে সেইসব মুসলিমদের ঠাঁই মেলেনি। কারণ হিন্দুত্ববাদী লেখক-বুদ্ধিজীবী ও কুচক্রীরা মুসলিমদের মধ্যে বিভেদের হাতিয়ার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে বারবার সামনে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে।
হিন্দুত্ব পাঠ:
বইয়ের মধ্যে বেশিরভাগ অনুচ্ছেদে হিন্দু ধর্ম, হিন্দু স্থাপত্য, হিন্দু সংস্কৃতি এবং ভারতীয়দের আদলে মূর্তি পূজার ইতিহাস শেখানো হয়েছে। এমনকি অযাচিতভাবে বেদ কি তা শিখানো হয়েছে। এছাড়া, সম্রাট অশোককে বিশ্বনেতার আসনে বসানো হয়েছে।
বইটিতে মোট ২৭টি ম্যাপের মধ্যে দুইটি আছে বাংলাদেশের ম্যাপ।
মুসলমানদেরকে খারাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে:
বইটির সম্পাদনামণ্ডলীতে ছিলেন ৪ জন হিন্দু। বইটিতে মুসলমানদের সম্পর্কে ঢালাওভাবে খারাপ ধারানো সূক্ষ্মভাবে ছড়ানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে। এতে ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা হয়েছে যে আমাদের বংশধরেরা হিন্দু ছিলেন এবং এটিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ।
ইসলাম ধর্মে নিয়ে যা বলা হয়েছে:
বইটিতে সুলতানি আমল চ্যাপ্টারে ইসলাম ধর্মকে বিদেশীদের ধর্ম হিসেবে বুঝানো হয়েছে। বইটিতে বলা হয়েছে যে, কিছু বিদেশী এসে কিছুদিনের জন্য জোর জবরদস্তি করে হিন্দুদের ক্ষতি করে গেছে। অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারকে হিন্দুত্বের ক্ষতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে বইটিতে।
সুলতানি আমলকে মুঘল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো হয়েছে এবং এতে বলা হয়েছে যে সুলতানী আমলেও নারীদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। অথচ হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা, মন্দিরগুলোতে নারীদের পুরোহিতদের ভোগের পণ্য হিসেবে বানিয়ে রাখার রীতিনীতি সুলতানি আমলে অনেকটাই কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন মুসলমান শাসকেরা। কিন্তু, হিন্দু পুরোহিতরা মন্দিরে তথাকথিত দেবতাদের ভোগের নামে নারীদেরকে ভোগ থেকে বিরত থাকতে চাইতেন না।
সুলতানী আমলকে বিদেশীদের আমল হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়েছে। বইটির ১১৯ পৃষ্ঠায় সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক অবস্থায় বলা হয়েছে, “তোমাদের যদি জিজ্ঞেস করি, ‘বিদেশি’ বলতে তোমরা কাদেরকে বুঝাবে? তোমরা চোখ বন্ধ করে বলবে, বিদেশি হলো তারাই যারা আমাদের দেশ অর্থাৎ বাংলাদেশের বাইরে থেকে এই দেশে এসেছে। তোমাদের উত্তর একদম সঠিক।”
সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক অবস্থা :
এই পরিচ্ছেদে সূক্ষ্ম প্রতারণা করা হয়েছে । তাঁরা সুলতানী আমলে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা যে হিন্দু রাজাদের শাসনামল থেকে ভাল ছিলো তা এড়িয়ে গেছেন। এতে লেখা হয়েছে, “দিল্লী সালতানাতের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে সেই সময়ের কিছু লেখক যেমন মিনহাজ-ইস-সিরাজ, জিয়াউদ্দিন বারণি, শামস্-ই-সিরাজের লেখা থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা জানার জন্য সুলতানি আমলে বহিরাগত পর্যটকদের লেখা বিবরণী ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।”
ব্যস! এতটুকু লিখেই সুলতানি আমলের অর্থনৈতিক অবস্থার বিবরণ শেষ করা হয়েছে।
মূলত: এই বইটির মাধ্যমে ইতিহাস পাঠের নামে দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের জাতীয় সংস্কৃতি থেকে কোমলমতি ছাত্রদের সরিয়ে নিয়ে হিন্দুত্ববাদি সংস্কৃতি শেখানো হচ্ছে। গত চৌদ্দ বছরে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার ভারত তোষণ-পোষণের অংশ হিসেবেই মুসলিমদের শৌর্য-বীর্য ও গৌরবের ইতিহাসকে ধুলোয় মেশানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এর বদলে হিন্দুত্ববাদকে মহান হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।