দিল্লীর শৃঙ্খলমুক্ত সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সিপাহি-জনতার বিপ্লবের ৭ নভেম্বর

0

কাল ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর। দিল্লীর শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের দিন এটি। ইতিহাসের পাতায় এই দিনটি স্বীকৃতি পেয়েছে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ নামে। নারায়ে তাকবীরের ধ্বনি ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে সেনাবাহিনী ও জনতার সম্মিলিত বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল এই দিনে। সংহতি বা জাতীয় ঐক্য হয়েছিল তৎকালীন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে। এই ঐক্যের লক্ষ্য ছিল দিল্লীর শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আজ থেকে ৪৭ বছর আগে ১৯৭৫ সালের এই দিনেই সিপাহি-জনতার ঐক্যের ভিত্তিতেই খালেদ মোশাররফ কর্তৃক বন্দি জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। বিপ্লবের সূচনাতে লক্ষ্য অনুযায়ী জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। বিপ্লবীদের টার্গেট মোতাবেক সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তাঁর হাতে।

৭ নভেম্বরের বিপ্লবের তাৎপর্য বুঝতে বা অনুধাবন করতে একটু পেছনে ফিরে দেখতে হবে। এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের একটি বাঁকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় পট পরিবর্তনের মাধ্যমে এক দলীয় বাকশালের পতন ঘটেছিল। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও মানবিক মর্যাদার চেতনাকে কবর দিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক দলীয় বাকশাল। সেনাবাহিনীর তৎকালীন একদল সাহসী, দেশপ্রেমিক ও উদ্যমী তরুণ অফিসারের নেতৃত্ব বাকশাল থেকে মুক্তি লাভের পাশাপাশি দিল্লীর শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার সূত্রপাত হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। কিন্তু ৩ নভেম্বর ভোর রাতে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটান তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ। গৃহবন্দি করা হয় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে। পদচ্যুত করা হয় ১৫ আগস্ট বাকশাল পতনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের রাষ্ট্রপতি খন্দকার মুশতাক আহমদকেও। তাঁকেও বন্দি করা হয় বঙ্গভবনের একটি কক্ষে। ১/১১-এর মূল নায়ক জেনারেল মঈন ইউ আহমদ ছিলেন তখন খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পক্ষে। এবং তিনি নিজেই স্মৃতিকথায় লিখেছেন, খন্দকার মুশতাক আহমদকে বন্দি করার পর পাহারা দিয়ে রাখার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন তরুণ ক্যাপ্টেন মঈন ইউ আহমদ।

খালেদ মোশাররফ নূতন রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিয়োগ দেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে। ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানে সংশ্লিষ্ট সেনা অফিসারদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন খালেদ মোশাররফ। নিরাপদে দেশত্যাগ নিশ্চিত করতে খালেদ মোশাররফের স্ত্রীকে সঙ্গে দেয়া হয় একই বিমানে।

খালেদ মোশারফের অভ্যুত্থানে আবারো দিল্লীর শৃঙ্খলে দেশের সার্বভৌমত্ব:

এই অভ্যুত্থানের চরিত্র দেখেই শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন দেশের মানুষ। আবারো দিল্লীর দাসত্ব বরণ করতে যাচ্ছে জাতি এমন একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের মাঝে। ৩ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থানকারীদের আনুকূল্যে দিল্লীর দাসত্বের আওয়াজ উঠেছিল প্রকাশ্যে রাজপথেও। ক্ষমতাচ্যুত বাকশালের নেতা রাশেদ মোশাররফ (৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের নায়ক খালেদ মোশাররফের ভাই) ও তাঁর মা’র নেতৃত্বে বিলুপ্ত বাকশালের দিল্লীপন্থিরা নেমে এসেছিলেন রাজপথে, খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানাতে। এতে মানুষের মনে শঙ্কা, ভয় আরো বেড়ে যায়। মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠে খালেদ মোশাররফ কি চাচ্ছেন।

৩ নভেম্বর খালেদ মোশররফের অভ্যুত্থানের পরই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে দেশ প্রেমিক সিপাহী এবং অফিসাররা ফুঁসে উঠেন। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ সংক্ষুব্ধ হয়ে সুযোগের অপেক্ষায়। যার প্রমান পাওয়া গিয়েছিল ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টার পর থেকে। অর্থাৎ ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে।

যেভাবে অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল:

মেজর (অব) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তমের সর্বশেষ লেখা বই-‘জিয়া থেকে খালেদা তারপর’-বইয়ে ৭ নভেম্বর বিপ্লবের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর কিছু অফিসারের নেতৃত্ব গঠিত হয়েছিল গোপন সংগঠন ‘সেনা পরিষদ’। বইটিতে উল্লেখিত বর্ণনা অনুযায়ী, পাকিস্তানের সামরিক ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সেনা অফিসারদের বেশিভাগ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বুঝেছিলেন স্বাধীনতার পর দেশকে দিল্লীর রাহুমুক্ত করতে হলে তাদের সংগঠিত হতে হবে। তাই সেনা পরিষদ নামে গোপন সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল তখনই। এই সেনা পরিষদ এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কামান্ডার কর্ণেল তাহেরর নেতৃত্বে গঠিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও জাসদের গণবাহিনীর যৌথ বৈঠকে ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৩ নভেম্বর থেকে ৬ নভেম্বর রাত ১২টায় বিপ্লবের সূচনা হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে দেশপ্রেমিক শ্লোগান সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করে সেনাবাহিনীর জওয়ানদের সংঘটিত করার চেষ্টা চালানো হয়। চূড়ান্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টায় বিপ্লবের সূচনা হয়ে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। মেজর শরিফুল হক ডালিম তাঁর বইয়ে ২৭ নং পৃষ্ঠায় বিপ্লবের শুরু হওয়ার বর্ণনায় লিখেন-“রাত ১১ টা। বঙ্গভবনে খালেদ ও শাফায়াত তাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধ করার জন্য কাগজপত্র ঠিকঠাক করায় যখন ব্যস্ত, তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতের আঁধারে সচল হয়ে উঠে বিভিন্ন ইউনিট। তারা সবাই প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধু বিদ্রোহের সংকেতের।

২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের পাশেই ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। খালেদ চক্রের দ্বারা বহিষ্কৃত অধিনায়ক কর্ণেল আমিনুল হক, এবং এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন মুনিরুল ইসলাম চৌধুরীকে ইতোমধ্যে চুপিসারে ডাকিয়ে আনা হয়েছে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। তখন দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের দায়িত্বে থাকা মেজর মহিউদ্দিনকে সার্বক্ষণিকভাবে সব বিষয়ে সাহায্য করছেন মেজর আনিস, ক্যাপ্টেন মোস্তফা, ক্যাপ্টেন কামাল, ক্যাপ্টেন জুবায়ের ও কয়েকজন বিশ্বস্ত জেসিও এবং তাদের অধীনস্থ সৈনিকরা। বিমান বাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন ফ্লাইট সার্জেন্ট আবসার। ল্যান্সারের ট্যাংক গুলোর নিয়ন্ত্রণ করছিলেন রিসালদার সারোয়ার। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপ্রান্তে বালুরঘাটে অবস্থিত সার্ভিস কোরের ইউনিট গুলো, মেডিকেল, সাপ্লাই, ইএমই ব্যাটালিয়ান গুলো ইতোমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। রেল ক্রসিং পার হলে অর্ডিন্যান্স ডিপো। উত্তর-পশ্চিমপ্রান্তে সিগন্যাল সেন্টার, ইঞ্জিনিয়ার্স ও লাইট অ্যাকশন ইউনিট গুলো বিপ্লবের সংকেতের অপেক্ষায় সার্বিকভাবে প্রস্তুত।

সশস্ত্র সবাই। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কর্ণেল তাহের এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জমায়েত হচ্ছেন বায়তুল মোকাররম, ইউনিভার্সিটি, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, কাঁটাবন, ইব্রাহিমপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, মগবাজার, এয়ারপোর্ট, মহাখালী, বনানী, টিভি এবং রেডিও স্টেশন এলাকায়। মতিঝিল, শান্তিনগর, প্রেসক্লাব, নিউমার্কেট, শাহবাগ এলাকায়ও সমবেত হচ্ছেন জনগণ। দ্বিতীয় ফিল্ড হেডকোয়ার্টারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিলেন কর্ণেল তাহের। কি ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে খালেদ-চক্র এবং অন্যান্যরা কিছুই জানতে পারছিল না। চরম মুহূর্ত রাত ১২ টা। বিস্ময়কর এবং অবিস্মরণীয় ঘটনার সূচনা হতে চলেছে। দেশবাসীকে শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্ত করতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আরো একটি বিপ্লব সংঘটিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে চলেছে।

মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে দ্বিতীয় ফিল্ডের একটি কামান থেকে আকাশে ছোঁড়া হল একটি ট্রেসার গোলা। রাতের আঁধার চিরে গোলাটি বিস্ফোরিত হওয়ায় আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের সূচনা সঙ্কেত ছিল এটি।”

এই প্রসঙ্গে বইটিতে আরো উল্লেখ করা হয়-“বিপ্লবের সূচনা সঙ্কেত বেজে উঠার সাথে সাথে ট্যাঙ্ক বহর সচল হয়ে বের হয়ে আসে। সাথে সাথে ক্যান্টনমেন্টের প্রস্তুতি নিয়ে থাকা অন্যান্য যানবাহন গুলো সচল হয়ে উঠলো। রণসজ্জায় সজ্জিত সৈনিকদের কাফেলা দলে দলে বের হয়ে আসতে শুরু করে। এই আওয়াজের পরপরই ঢাকার রাস্তায় নেমে আসে সাধারণ মানুষ।”

এই বর্ণনা থেকে দুইটা বিষয় স্পষ্ট। ক্যান্টনমেন্টের ভেতর ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে। যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালিন মেজর মহিউদ্দিন আহমদ। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সংগঠিত করার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কর্ণেল তাহের বীর উত্তম।

যেভাবে মুক্ত করা হয় জিয়াউর রহমানকে:

মেজর শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তমের লেখায় উল্লেখ করা হয়, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের পরিকল্পনায় প্রথম লক্ষ্য ছিল সূচনাতেই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা। মুক্ত জিয়ার হাতে বিপ্লবের কমান্ড হস্তান্তর করা। ‘জিয়া থেকে খালেদা তারপর’ বইয়ের ৭ নভেম্বরের বর্ণনায় আরো উল্লেখ করা হয়-“পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী বিপ্লবের সূচনা পর্বেই ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে আর্টিলারি, ল্যান্সার, সিগন্যাল, ইঞ্জিনিয়ার, ইএমই, সাপ্লাই, অর্ডন্যান্স ও মেডিকেল কোরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি ট্যাঙ্কের শোভাযাত্রা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী শ্লোগান দিতে দিতে আর্মি চীফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের মইনুল রোডের বাড়ির দিকে যায়। বিপ্লবীদের শ্লোগানে ভীত হয়ে জিয়াউর রহমানকে বন্দি করে রাখার জন্য খালেদ মোশাররফ কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত আর্মি অফিসাররা পালিয়ে যান। বিপ্লবীরা বাড়ির গেইটে পৌঁছালে সেখানে গেইট ভেতর থেকে তালাবদ্ধ ছিল। গেইট ভেঙ্গেই ভেতরে ঢুকে জিয়াউর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে আসেন মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একটি দল। জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে সৈনিকরা কাঁধে তুলে ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসেন।

বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় বিপ্লবীদের মুখে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত উচ্চারণ গুলো ছিল-‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার, সিপাহী-জনতা ভাই ভাই, খালেদ চক্রের রক্ষা নাই, জিয়া আছে যেখানে, আমরা আছি সেখানে।’ এই শ্লোগানে মুখরিত করেই মইনুল রোড থেকে ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জিয়াউর রহমানকে।

এই সময়ে শ্লোগানের পাশাপাশি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বিপ্লবীদের পক্ষ থেকে আকাশে ছোড়া হয় অনবরত ট্রেসার। রাতের অন্ধকারে ছোড়া ট্রেসারের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উটে ঢাকার আকাশ। ততক্ষণে ঢাকার রাজপথে রাতের আঁধার মারিয়ে নেমে আসে জনতার ঢল। সিপাহী, জওয়ানরাও ক্যান্টনমেন্ট থেকে দলে দলে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে রাজপথে জনতার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। জনতার মুখেও তখন ‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে। সিপাহীদের ট্যাঙ্ক বহরের মধ্যে জনতা উঠে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করে তখন। জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার পর এভাবেই মিলিত হয়ে সিপাহি-জনতা এক মোহনায়। এই বিপ্লবের নাম দেয়া হয়-জাতীয় সংহতি বা সিপাহী জনতার সম্মিলিত বিপ্লব।

জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করার পরপরই তাঁকে বিপ্লবের মধ্যমণি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সেনা প্রধান হিসাবে দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার পরই বিপ্লবের কমান্ড নিজের হাতে নেন। আর তাই তো পরের দিন খবরের কাগজের শিরোনাম হয়-‘জিয়ার নেতৃত্বে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান’।

যেভাবে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন খালেদ চক্র:

৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বঘোষিত সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফের¡ বঙ্গভবনে তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে মিটিংয়ে ব্যস্ত। এই মিটিংয়ে ঢাকার ৪৬তম ব্রিগেডের কমান্ডার কর্ণেল শাফায়াত জামিল, কর্ণেল রউফ, কর্ণেল নুরুজ্জামান, মেজর মালেক (পরবর্তীতে কর্ণেল), কর্ণেল মুন্নাফ, কর্ণেল নাজমুল হুদা, মেজর হায়দার, মেজর হাফিজ এবং খালেদের ভায়রা ভাই কে কিউ হুদা উপস্থিত ছিলেন। হঠাৎ করেই খালেদ মোশাররফের পাশে রাখা ফোন বেজে উঠে। ধারণা করা হয় ফোনটি খালেদ মোশাররফের স্ত্রী করেছিলেন। তাঁকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বিদ্রোহের অবস্থা জানানো হয়। খালেদ চক্রের বিরুদ্ধে গগণ বিদারী শ্লোগানের কথা অবহিত করা হয়। এই খবর শোনে খালেদ মোশাররফ উপস্থিত সঙ্গীদের জানালেন, কাউন্টার ক্যু করার চেষ্টা করছে কেউ। মেজর হাফিজকে বলা হয় অবস্থা সরেজমিনে দেখে আসার জন্যে। ইতোমধ্যেই চলন্ত ট্যাঙ্কের আওয়াজ ও রাজপথে জনতার শ্লোগানের আওয়াজ তাদের কানে শুনতে পান। এই অবস্থায় যে যেদিক পারলেন পালানোর চেষ্টা করেন তখন। স্বঘোষিত সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ তাঁর একান্ত বন্ধু কর্ণেল হুদা, মেজর হায়দার ও কে কিউ হুদাকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রাইভেটকারে করে বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। কলাবাগানে খালেদ মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সামরিক ড্রেস পরিবর্তন করে সিভিল ড্রেস পরিধান করেন। সিভিল ড্রেসে তারা ফার্মগেটের কাছে গিয়ে দেখলে সিপাহী জনতার উল্লাসিত ঢল। এই অবস্থায় শেরেবাংলা নগরে ১০ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ইউনিট কে ফোর্সের অধীনে ছিল। তাদের ধারণা ছিল এখানে নিরাপত্তা পাবেন তারা। এখানেই উত্তেজিত সৈনিকদের হাতে প্রাণ হারান খালেদ মোশাররফ ও সঙ্গীরা।

খালেদ মোশাররফের শেষ পরিণতি:

সাবেক জাসদ নেতা মহিউদ্দিন আহমদেও লেখা ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থিও সময়ের রাজনীতি’ বইয়ের ২০০নং পৃষ্ঠায় খালেদ মোশাররফ ও তাঁর সঙ্গীদের শেষ পরিণতি প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে সাবেক স্টেশন কমান্ডার লে. কর্ণেল হামিদের বই থেকে উদ্ধৃত করেন। স্টেশন কমান্ডার লে. কর্ণেল এম এ হামিদ লিখছেন, বেলা ১১ টায় ল্যান্সনায়ক, ড্রাইভার মনোয়ার আমার জীপ নিয়ে ফিরে এল। অফিসে কোন কাজ নেই দেখে আমি সিএমএইচ-এ খালেদ মোশাররফকে দেখার জন্যে চললাম। পৌঁছে দেখি সেখানে খালেদ মোশাররফের লাশ একেবারে মর্গের সামনে খোলা মাঠে নির্দয়ভাবে ফেলে রাখা হয়েছে। চতুর্দিক থেকে সৈনিকরা দলে দলে এসে চার দিনের বিপ্লবে নিহতদের দেখছে। কেউ কেউ থুথু দিচ্ছে। আমি সিএমএইচ-এর কোন অফিসারকে পেলাম না। সুবেদার সাহেবকে বললাম খালেদ একজন সিনিয়র অফিসার। তাই তার লাশটা এভাবে অসম্মান না করে মর্গে তুলে রাখার জন্যে। তিনি তখনই লাশটা সরাবার ব্যবস্থা করার জন্যে ডোম ডাকতে গেলেন। হুদা ও হায়দারের লাশ মর্গেই ছিল। (অপর যে দুইজন নিহত হয়েছিল, যে দুই ভারতীয় দালাল সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন খালেদ মোশারফের সাথে। তারা ছিলেন হুদা এবং হায়দার। ) ৯ তারিখ খালেদ মোশাররফের এক চাচা শহর থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন খালেদের লাশটি নিয়ে যাওয়ার জন্যে। ভয়ে খালেদের পরিবার পালিয়ে বেড়াচ্ছে। গত দুইদিন ধরে অবহেলায় লাশটি পড়ে আছে। কেউ আসতেছে না। আমি তখনই তাঁকে স্টেশন হেডকোয়ার্টারে আসতে বললাম। তিনি তখন ক্যান্টনমেন্টে আসতে রাজি হলেন না। অগত্যা বনানী স্টেশনের কাছে গিয়ে খালেদের লাশ তাঁর হাতে পৌঁছে দেয়া হল। তিনি সেনানিবাস গোরস্থানে খালেদকে দাফন করার অনুমতি চাইলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলাম। কিছুক্ষণ পর বললেন, তাঁর কাছে কোন লোকজন নেই। যদি কবরটা খুড়ে দেয়া যায়। আমি তৎক্ষণাৎ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড অফিসারকে ডেকে ব্রিগেডিয়ার খালেদের কবর খুড়ার জন্য সিভিলিয়ান মালী পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম। বিকেলে আবার তিনি ফোন করলেন, খালেদের আত্মীয়স্বজন সবাই ভীত সন্ত্রস্ত। তারা সন্ধ্যার দিকে খালেদকে দাফন করতে চায়। তাই একটু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করলেন। আমি বললাম দেখুন, আপনি কি সিপাহি গার্ড চাচ্ছেন? তিনি বললেন, তওবা তওবা। তখন আমি বললাম, আমি নিজে সন্ধ্যার সময় ওখানে হাজির থাকব। আপনারা নির্বিঘ্নে খালেদকে নিয়ে আসুন। সন্ধ্যা বেলা ঘোর অন্ধকার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। রাস্তার লাইটে সীমিত আলোতে ক্যান্টনমেন্টের গোরস্থানে তড়িঘড়ি করে খালেদের দাফনকার্য সমাধা করা হল। উপস্থিত ছিলেন মাত্র চার-ছয়জন। অতি নিকট আত্মীয় চাচা, আর শুধু আমি ও আমার ড্রাইভার ল্যান্সনায়ক মনোয়ার। এভাবে শেষ হল ৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে কে ফোর্সের দুর্ধর্ষ কমান্ডার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের শেষ কৃত্য, গোপনে অন্ধকারে, সবার অগোচরে।’

দেশ দ্রোহীদের পরিণতি কি হয়, সেটার কিছুটা প্রমান পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার ও তাঁর নামে গঠিত কে ফোর্সের প্রধানের জীবনের শেষ দিনটির দিকে তাকালে।

দেশদ্রোহীদের পতনে উল্লাসিত ছিলেন জনতা:

মূলত ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হয় খালেদ চক্র। জাতীয় বেঈমান ও তাদের বিদেশী প্রভুদের সব চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে দেয় অকুতোভয় দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা। দেশের আপামর জনসাধারণ ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়ে সেনাবাহিনীর বীর জোয়ানদের সাথে যোগ দেয়। এই ঐতিহাসিক দিনে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র সংগ্রামী জনতার ঢল নেমেছিল পথে-প্রান্তরে, অলিতে-গলিতে, শহরে-গ্রামে। নামাজে শুকরানা আদায় করেছিলেন মুসল্লিরা মসজিদে-মসজিদে। শহর-বন্দরে খুশীতে আত্মহারা জনগণের মাঝে মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ এবং জনগণের একাত্মতায় সৃষ্টি হয়েছিল এক দুর্ভেদ্য জাতীয় ঐক্য। সেই দুই ক্রান্তিলগ্নে সম্মিলিতভাবে তারা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল এক দুর্জয় ঘাঁটিতে। সমগ্র জাতি প্রস্তুত ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যেকোন আগ্রাসন কিংবা হুমকির বিরোধিতা করার জন্য। সফল বিপ্লবের পর কুচক্রীদের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। কর্নেল শাফায়াত জামিল ও অন্যান্যদের বন্দী করা হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে আবার তাকে আর্মি চীফ অফ স্টাফের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আবেদন জানান। কিন্তু জনাব খন্দকার মোশতাক আহমদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবেদনে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে ঐদিনই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেন খন্দকার মুশতাক আহমদ। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে পূর্ণ সমর্থন জানান তিনি।

ঐতিহাসিক জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চেতনা ছিল জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেতনা, দিল্লীর অধিপত্যবাদের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার চেতনা। স্বৈরশাসন ও একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার চেতনা- এক কথায় বলতে গেলে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ বাকশালের পতন ও ৭ নভেম্বরের জাতীয় বিপ্লব ও সংহতির মাধ্যমে বৈপ্লবিক সফল অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। অম্লান হয়ে থাকবে নিজ মহিমায়। এই বিপ্লবের মাধ্যমেই বাকশাল ও আধিপত্যবাদের পতন ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিল।

উৎসঃ   আমার দেশ
Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More