পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) এ কে এম মাসুদ খান। অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতা এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। প্রভাবশালী নেতাদের ছত্রছায়ায় থেকে করে যাচ্ছেন নানা অপকর্ম। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও তাকে কিছু বলতে সাহস পায় না। মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর চাকরির শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ এনে চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। পুলিশ পরিদর্শক এ কে এম মাসুদ খান বর্তমানে মাদারীপুরের শিবচর থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। ২০১১ সালে তার জন্মতারিখ নিয়ে যখন তদন্ত ও একই সময়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে ঠিক সেই সময়ে অর্থাৎ ২২শে মে ২০১১ তারিখে ২৯৮০নং গেজেটে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হন এ কে এম মাসুদ খান। তার সনদ নম্বর ম-১৪৬৮৪৬, স্মারক নং-২৯৩২, তারিখ ১৪-০২-২০১০। এরপর ২০১৩ সালের ১০ই ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন পুলিশ পরিদর্শক এ কে এম মাসুদ খান। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এ বিষয়ের উপর তার পক্ষে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর ভিত্তিতেই গত ২৪শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রত্যায়ন করে। এ প্রত্যয়নপত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জমা দেন ওসি মাসুদ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওসি মাসুদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুক্তিযোদ্ধার প্রত্যয়নপত্র পেয়েই তড়িঘড়ি করে ২৫শে মার্চ পুলিশ মহাপরিদর্শক বরাবর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। তার এলপিআর-এ যাওয়ার তারিখ ছিল গত ৩০শে মার্চ। কিন্তু তিনি এলপিআর-এ না গিয়ে যথারীতি অফিস করতে থাকেন। ৩রা মার্চ এআইজি (সংস্থাপন) থেকে মাদারীপুর পুলিশ সুপারের কাছে তার চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধিসংক্রান্ত নির্দেশনা এসে পৌঁছে। ৩১শে মার্চ থেকে ২রা মার্চ পর্যন্ত তিনি এলপিআর-এ না গিয়ে চাকরিতে বহাল থেকে অফিস করার কারণ সম্পর্কে সঠিক জবাব দিতে পারেননি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ।
১৯৫৯ সাল যদি তার সঠিক জন্ম সাল হয় তাহলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১২। ১৯৭১ সালের ১২ বছরের শিশু ২০১০ সালে হঠাৎ করে হয়ে যান মুক্তিযোদ্ধা। এমনকি মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়ে চলতি এপ্রিল মাসে এক বছর চাকরির মেয়াদও বৃদ্ধি করেছেন তিনি।
বিষয়টি জানার জন্য ভাঙ্গা উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে জানতে চাইলে ভাঙ্গার এক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, মাসুদকে আমরা কখনও যুদ্ধ করতে দেখিনি। তবে ভাঙ্গা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার আমিনুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় মাসুদ খান তাদের ইয়াং সোর্স ছিল বলে দাবি করেছেন।
মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রে জন্মতারিখ বা বয়স কত ছিল এবং কোথায় যুদ্ধ করেছেন এ প্রশ্নের উত্তরে ওসি মাসুদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৬, আমি স্কুলছাত্র ছিলাম এবং পরীক্ষা দিয়েছিলাম। আমি দেশের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করেছি, অনেক জায়গায় ছিলাম।’ কোন স্কুলে পড়েছেন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এ বিষয় আমি আপনার কাছে বলবো না। এই তো গেলো তার চাকরির শেষ সময়ের কেরামতি। এছাড়া চাকরির শুরু থেকে তিনি দেখিয়েছেন বিভিন্ন কেরামতি। তিনি ১৯৭৭ সালে ফরিদপুর জেলায় কনস্টেবল পদে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি হন। তখন পুলিশ ভেরিফিকেশন রোলে তার জন্মতারিখ ৩১শে মার্চ ১৯৫৫ এবং শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণী। তিনি সিআইডি ঢাকায় কর্মরত থাকাকালে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১৯৯৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে উত্তীর্ণ হন। এসএসসি পরীক্ষার সনদপত্রে তার জন্মতারিখ ১৩-০৩-১৯৭৮। জন্মগ্রহণের আগেই তার চাকরি হয়েছে!
চাকরিতে যোগদানের সময় কাগজপত্রে তার জন্ম সাল ছিল ১৯৫৫। কিন্তু পুলিশের খতিয়ান বইতে ঘষামাজা জন্ম সাল লেখা হয়েছে ১৯৫৯। জন্ম তারিখ পুলিশ খতিয়ানে ১৯৫৯ এবং এসএসসি সার্টিফিকেটে ১৯৭৮ সাল থাকলেও তিনি একের পর এক পদোন্নতি পেয়েছেন। জন্মতারিখ বিভিন্ন হওয়ায় অবসর গ্রহণের তারিখ নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয় পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। তাই ২০১১ সালে মুন্সীগঞ্জ জেলায় চাকরিরত থাকা অবস্থায় তার অবসর গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করার জন্য তার সঠিক জন্মতারিখ জানাতে ‘জিএ/৫৫-২০০৫ (অংশ-৩) (ইন্স)/১৬১৩’ স্মারকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ হেডকোয়ার্টাসের এআইজি (সংস্থাপন) মো. আমিনুল ইসলাম তদন্ত করেন। তদন্ত শেষে তিনি মতামত প্রদান করেন, ‘বিষয়টি অভিনব’। এ বিষয়ে শিবচর থানার (ওসি) এ কে এম মাসুদ খান বলেন, ‘এসএসসি’র কাগজে জন্মতারিখ ভুল ছিল। এগুলো নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। পুলিশ খতিয়ান বইতে ঘষামাজার বিষয়টি আমি জানি না, এটা কেউ শত্রুতা করেছে। সেখানে জন্মতারিখ ও বিপি নম্বর ভুল ছিল ৫৯, এখন তা ৫৫ করা হয়েছে। এখন আমার সব কাগজপত্রে জন্ম সন ১৯৫৫।’ ঘষামাজা করে লেখা ভুল জন্ম তারিখ-সন স্বীকার করে নিয়েই নিজের অফিসিয়াল সিলে বিপি নম্বর ৫৯ কেন ব্যবহার করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে এখন খোঁচাখুঁচি করে লাভ নেই। এজন্য আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে অর্ডার করিয়ে এনেছি। অফিসিয়াল সিক্রেসি অনুযায়ী এগুলো তো আপনি জানতে পারেন না।
মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্ত না হওয়ায়, ইতিপূর্বে চাকরিরত অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা না দেয়ায় এবং তার ৩টি জন্ম সন তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। ফলে তার মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে পুনরায় গোয়েন্দা সংস্থা ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ তদন্ত শুরু করেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শকের সামনে হাজির হয়ে তার চাকরির পূর্ণাঙ্গ বিবরণসহ বক্তব্য পেশ করার জন্য নির্দেশও দেয়া হয়েছে। এ তথ্য দিয়েছে তার একটি বিশ্বস্ত সূত্র।