সোমবার (২০ মার্চ) প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক বাংলাদেশে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়নের একটি বর্ণনাও তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রবাসে ভিন্নমতাবলম্বীদের আত্মীয়স্বজনকে কিভাবে দেশে হয়রানি করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়-বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যারাই প্রতিবাদ করছে, তাদের বেশিরভাগের পরিবারের সদস্যদেরকে নানান ভয়-ভীতি, হয়রানি, মিথ্যা মামলার পাশাপাশি গ্রেফতার করছে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার।
বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার (২১শে মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে অন্যান্য দেশের সাথে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের অবনতিশীল মানবাধিকার পরিস্থিতি চিত্র বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি মানবাধিকার রক্ষাকারী, সুশীল সমাজের নেতা এবং দেশের বাইরে অবস্থিত ভিন্নমতের ব্যক্তিদের বাংলাদেশে বসবাসকারী পরিবারের সদস্যদের হয়রানি এবং নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।
এতে বলা হয়, গত মার্চ মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের সরকারকে গুমের শিকার ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজন এবং মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাংবাদিক কনক সারওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকা ১৬০ দিন কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি পান। ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি জামিনে ছিলেন, যদিও তার বিরুদ্ধে মামলা অব্যাহত রয়েছে এবং কয়েক মাস পর পর শুনানি হয়। ।
২০২১ সালের অক্টোবরে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ডিএসএ লঙ্ঘন ও মাদক রাখার অভিযোগে রাকাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কনক সারওয়ার বিশ্বাস করেন যে, অনলাইনে অনুষ্ঠানে ভিন্নমতের প্রতিশোধ হিসাবে তার বোনের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলি আনা হয়েছে। তার বোন কোনও অপরাধ করেনি। ২০২০ সালে হাইকোর্ট সারওয়ারের ওয়েবসাইটগুলো বন্ধ করার নির্দেশ দেয়। সরকারের ভাষ্য মতে সেখানে তিনি ‘রাষ্ট্রবিরোধী বিকৃত কনটেন্ট’ শেয়ার করেছেন।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারের সমালোচনার প্রতিশোধ হিসেবে লন্ডনভিত্তিক সাপ্তাহিক সুরমা সম্পাদক শামসুল আলম লিটনের ভাই নূর আলম চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত নভেম্বরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্যসহ মফিজুর রহমান ও মুশফিকুল ফজল আনসারীর বিরুদ্ধে মামলা করে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৪ অক্টোবর ফ্রান্সে বসবাসরত পিনাকীর একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস লক্ষ্য করে সিটিটিসি। পুলিশের দাবি, পরে গ্রেপ্তার হওয়া রহমান আনসারী ও পিনাকীর সঙ্গে ভুল তথ্য শেয়ার করেন।
গত নভেম্বরে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, কানাডায় বাংলাদেশ হাইকমিশন বাংলাদেশি কানাডিয়ানদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, একদল ব্যক্তি কানাডার বিরুদ্ধে বানোয়াট ও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়েছে। এসব ব্যক্তিকে অর্থ পাচারকারী, ঋণখেলাপি ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি আখ্যায়িত করে হাইকমিশন বলেছে, বাংলাদেশ সরকার এ ধরনের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং টরন্টো কনস্যুলেট তাদের কনস্যুলার সেবা প্রত্যাখ্যান করবে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার চুক্তিগুলোর আলোকে প্রণীত বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক এই বার্ষিক প্রতিবেদনে পৃথিবীর ১৯৮টি দেশ ও অঞ্চলের স্থানীয় মানবাধিকার ও শ্রমিকদের অধিকারের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র বিগত প্রায় পাঁচ দশক ধরে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মানবাধিকারকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির কেন্দ্রে রেখেছেন।
দেশ ও অঞ্চলভিত্তিক ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে কোনো আইনি সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় না কিংবা মানবাধিকার পরিস্থিতির ভিত্তিতে প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর কোনো ক্রমতালিকা বা তুলনা করা হয় না।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা শুরু হয়েছে ‘সর্বজনীন’ শব্দ দিয়ে, কারণ বিশ্বের দেশগুলো সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কিছু নির্দিষ্ট অধিকার রয়েছে যা (বিশ্বের) প্রতিটি মানুষ, সর্বত্র ভোগ করার অধিকার রাখে। যুক্তরাষ্ট্র সেসব অধিকার রক্ষায় বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামী মানুষের পাশে থেকে সবসময় সমর্থন করে যাবে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, স্বতন্ত্র ব্যক্তির অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন একটি অধিকতর নিরাপদ, স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধশালী বিশ্ব গড়ে তুলতে সহায়তা করে। (মানুষের) মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিতির মূল দিকটি ফুটে উঠে। যুক্তরাষ্ট্র সম্মান, শ্রদ্ধা ও অংশীদারিত্বের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়মিতভাবে মানবাধিকারের বিষয়গুলো বাংলাদেশ সরকারের কাছে তুলে ধরছে। এই ধারা আগামীতেও অব্যাহত থাকবে।