প্রাণ’র আমজাদ খান চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী ছিলেন

0
যুদ্ধাপরাধী মেজর জেনারেল (অব:) আমজাদ খান চৌধুরী
যুদ্ধাপরাধী মেজর জেনারেল (অব:) আমজাদ খান চৌধুরী

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী মেজর জেনারেল আমজাদ খান চৌধুরী (অব:) যুদ্ধাপরাধী বাঙালি বংশোদ্ভুত পাকিস্তানী সেনা ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুর ক্যান্টনমেন্টের বিএম-২৩ ব্রিগেডের মেজর আমজাদ খান চৌধুরীর অধীনে বাঙালি সেনা-মুক্তিযোদ্ধা-সাধারণ মানুষকে হত্যার ঘটনা ঘটে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরেও অংশ নেন। রংপুরে অবস্থানকালে তিনি হত্যা-ধর্ষণসহ হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করার কাজেও জড়িত ছিলেন।

পরবর্তীতে আমজাদ খান চৌধুরী পাকিস্তানে চলে যান। তার পাকিস্তান যাওয়ার ব্যাপারে একটি ভাষ্য হল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতীয় সেনাদের হাতে আটক হয়ে সিমলা চুক্তির মধ্যমে পাকিস্তানে যান তিনি। আরেকটি ভাষ্য হল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে তিনি পাকিস্তান বদলি হয়ে যান।

পরে পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া চার লাখ বাঙালির সাথে দেশে ফিরে “মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকে পড়া সেনা” পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে যোগ দেন আমজাদ খান চৌধুরী। তিনি সেনাবাহিনীতে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল পর্যন্ত র‍্যাংক পেয়েছিলেন।

১৯৮১ সালে সেনাবাহিনী থেকে বাধ্যতামূলক অবসর পেয়ে ব্যবসায় নামেন তিনি।

গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭ টা ১৫ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় ডিউক মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান আমজাদ খান চৌধুরী। তার বয়েস হয়েছিল ৭৬ বছর।

আমজাদ খান চৌধুরীর মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধী পরিচয় আড়াল করে তার ব্যবসায়ী পরিচয়কে সামনে রেখে গণমাধ্যমে তার মৃত্যুর খবর পরিবেশন করা হচ্ছে। এমনকি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শোকও জানানো হয়েছে।

আমজাদ খান চৌধুরী ছিলেন অমুসলিম আহমদিয়া (কাদিয়ানী) সম্প্রদায়ের সদস্য। কিন্তু মৃত্যুর পর তাকে মুসলিম হিসেবে গণমাধ্যমে পরিচয় দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর খবর প্রচারে ইন্না লিল্লাহি…রাজিউন দোয়াও ব্যবহার করা হয়েছে।

এই মুসলিম পরিচয় দেয়ার নেপথ্য কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় পরিচয় লুকিয়ে থাকা আমজাদ খান চৌধুরী আসলে একজন সন্দেহাতীত যুদ্ধাপরাধী।

আমজাদ খান চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৯ সালের ১০ নভেম্বর। তিনি নাটোর জেলার সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা প্রয়াত আলী কাশেম খান চৌধুরী ও মা প্রয়াত আমাতুর রহমান।

রাজধানী ঢাকার বকশিবাজারে আহমদিয়াদের (কাদিয়ানী) সেন্টারের পাশে নবকুমার ইনস্টিটিউটে তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে অস্ট্রেলিয়ান স্টাফ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের চারদিনের মাথায় বাঙালি সেনা হত্যা

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী সেনারা নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের উপর গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এর মাত্র চারদিনের মাথায় ৩০ মার্চ রংপুর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে যাওয়ার পথে  ৩য় বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ন অ্যাডজুটেন্ট সিরাজ ও তার ১০/১২ জন সশস্ত্র প্রহরীর মধ্যে এক জন ছাড়া সবাইকে হত্যা করা হয়।

এ সময় রংপুর ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেড মেজর পদে আসীন ছিলেন বাঙালি মেজর আমজাদ খান চৌধুরী।

বাঙালি সেনা হত্যায় মেজর আমজাদ খান চৌধুরীর সংশ্লিষ্টতার এই ঘটনার কথা কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীরবিক্রম তার লেখা “একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর” বইয়ের ৫০ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।

শাফায়াত জামিল লেখেন, “৩০ মার্চ ৩য় বেঙ্গলের ব্যাটালিয়ন আডজুটেন্ট সিরাজকে রংপুর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে একটা কনফারেন্সে যোগ দেয়ার জন্য পাঠানো হয়। তার সঙ্গে ১০/১২ জন সশস্ত্র প্রহরী ছিল। পাকিস্তানিরা পথে তাদের বন্দী করে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় সে রাতেই প্রায় সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দলটির মাত্র একজন সদস্য দৈবক্রমে বেচে যায়। পরে সে ৩য় বেঙ্গলের সঙ্গে মিলিত হতে পেরেছিল। উল্লেখ্য, তখন রংপুর ব্রিগেডের গুরুত্বপূর্ণ ব্রিগেড মেজর পদের আসীন ছিলেন একজন বাঙালি মেজর আমজাদ খান চৌধুরী।”

বাঙালি সেনাদের হত্যা ছাড়াও আমজাদ খান চৌধুরীরে নেতৃত্বে পাকিস্তানী সেনারা একাধিকবার মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত হন।

এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের সময় রংপুরে হত্যা-ধর্ষণসহ হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাটে নেতৃত্ব দেন মেজর আমজাদ চৌধুরী।

আমজাদ খান চৌধুরীর বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যাওয়ার ও স্বদেশে ফেরার ব্যাপারে দুটি ভাষ্য পাওয়া যায়।

একটি ভাষ্যমতে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাদের সাথে মিত্র বাহিনীর কাছে আমজাদ খান চৌধুরীও আত্মসমর্পণ করেন। পরে যুদ্ধবন্দি হিসেবে তাকে ভারতের নিয়ে বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়।

১৯৭২ সালের ২ জুলাই আগস্টে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক ‘সিমলা চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তিটি ১৯৭২ সালের ৪ আগস্ট থেকে কার্যকর হলে চুক্তির শর্তাধীনে ভারত সকল যুদ্ধবন্দিকে বিনাবিচারে পাকিস্তানে ফেরত পাঠায়। তখন মেজর আমজদা খান চৌধুরীসহ যুদ্ধবন্দিরা পাকিস্তানে চলে যান।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাদের সাথে মিত্র বাহিনীর কাছে আমজাদ খান চৌধুরী আত্মসমর্পণ করেন। পরবর্তীতে যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানী সেনা হিসেবে তাকেও ভারত নিয়ে বন্দি শিবিরে আটক রাখা হয়। সিমলা চুক্তির পর পাকিস্তানী সেনা হিসেবে তিনি দেশটিতে ফেরত যান।

তবে আরেকটি ভাষ্যমতে, আমজাদ খান চৌধুরী অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে পাকিস্তানে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন।

পরবর্তীতে পাকিস্তান থেকে আটকে পড়া চার লাখ বাঙালির সাথে দেশে ফিরেন আমজাদ খান চৌধুরী। দেশে ফিরে তিনি “মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকে পড়া সেনা” পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে যোগ দেন।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরও আমজাদ খান চৌধুরী বিতর্কিত ভূমিকা রাখেন বলে জানা যায়।

কর্নেল শাফায়াত জামিলের বরাতে জানা গেছে, “তিনি (আমজাদ খান চৌধুর) ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন এবং তারই নিয়োজিত সেনা দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের পাহারার দায়িত্বে ছিল। আক্রমণকারীদের প্রতিরোধে এরা সেদিন ব্যর্থ হয়। সব সম্ভবের দেশ এই বাংলাদেশে তিনি পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয়েছিলেন।”

অন্যদিকে সেনা বাহিনী থেকে আমজাদ খান চৌধুরীর অবসরও বিতর্কিত ছিল। ১৯৮১ সালে দুর্নীতির দায়ে আমজাদ খানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সময়েই তার দুর্নীতির তদন্ত শুরু হয়েছিল।

সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার বছরেই আমজাদ খান চৌধুরী ১৯৮১ সালে তিনি রংপুরে টিউবওয়েল তৈরির কারখানা হিসেবে রংপুর ফাউন্ড্রি লিমিটেড (আরএফএল) প্রতিষ্ঠা করেন। আর ১৯৮৫ সালে তিনি গড়ে তোলেন এগ্রিকালচারাল মার্কেটিং কম্পানি, যার ব্র্যান্ড নাম প্রাণ।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এখন দেশের শীর্ষ কয়েকটি গ্রুপের একটি। তাদের উৎপাদন তালিকায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি পণ্য আছে। ১০৮টি দেশে প্রাণ-আরএফএল নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে পণ্য রপ্তানি করে।

যুদ্ধাপরাধীর জন্য রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর শোক!

বাঙালি সেনা-মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ ও হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুটপাটে জড়িত এবং যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক হয়ে ভারত-পাকিস্তানে যাওয়া যুদ্ধাপরাধী হলেও জীবিত অবস্থায় বিচারের মুখোমুখি হননি আমজাদ খান চৌধুরী।

আর মৃত্যুর পর ‘দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী’ আখ্যা দিয়ে তার মৃত্যুতে ‘গভীর শোক’ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী।

এ ছাড়াও শোক জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ, বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম।

সামরিক কবরস্থানে হবে যুদ্ধাপরাধীর কবর!

আগামী রবিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমজাদ খান চৌধুরীর লাশ দেশে আনা হবে। যুদ্ধাপরাধী ও বাঙালি সেনা হত্যাকারী হলেও পরদিন সোমবার ঢাকায় সামরিক কবরস্থানে তাকে কবর দেয়া হবে।

আমজাদ খান চৌধুরীকে সামরিক কবরস্থানে কবর দেওয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন তার ছোট ছেলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহসান খান চৌধুরী।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More