বাংলাদেশে কালাকানুন করে মানুষের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে: শেখ হাসিনার সমালোচনার জবাবে স্টেট ডিপার্টমেন্ট
বিশ্বের এযাবতকালের সবচেয়ে কঠোর কালাকানুন (ড্র্যাকোনিয়ান) করে বাংলাদেশে মানুষের কন্ঠরোধ করা হচ্ছে। স্বাধীন গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়ে যাওয়াটা একটা বড় রকমের প্রশ্ন। গণমাধ্যমে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হচ্ছে সেটার প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন।
জাতীয় সংসদে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া আক্রমণাত্মক বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশে ইস্যুতে এভাবেই নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। সোমবার স্টেট ডিপার্টমেন্টের নিয়মিত ব্রিফ্রিংয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য, তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্ট নিয়ে তীর্যক মন্তব্য, র্যাব নিয়ে ডয়চে ভেলেতে সাক্ষাতকার দেওয়ায় নাফিজ মোহাম্মদ আলমকে গ্রেপ্তার এবং প্রথম আলো অফিসে অনুপ্রবেশ এবং হুমকি দেয়া প্রসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়।
বাংলাদেশের চলমান এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্রকে দোষারোপ প্রসঙ্গে স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রধান উপমুখপাত্র ভেদান্ত প্যাটেল বলেন, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বাংলাদেশ ১০ ধাপ পিছিয়েছে। এর বড় একটা কারণ হলো বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। গণমাধ্যম এবং তার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে তার প্রভাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।
যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে সোমবার সংসদে দেয়া ভাষণে শেখ হাসিনা বলেন, “তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? আমেরিকার টেনেসিস রাজ্যে তিন জন কংগ্রেসম্যান অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করেছিল। এই অপরাধে দুই জনকে কংগ্রেস থেকে এক্সপেলড করা হয়। একজন সাদা চামড়া ছিল বলে বেঁচে যান। কালো চামড়ার কারণে তাদের সিট আনসিট হয়ে যায়। তো এখানে মানবাধিকার কোথায়? এখানে গণতন্ত্র কোথায়? এটা আমরা প্রশ্ন।” যুক্তরাষ্ট্র ক্ষমতার উলট-পালট করে দিতে পারেও বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।
ব্রিফিংয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট সংবাদদাতা মুশফিকুল ফজল আনসারী জানতে চান, “ওয়াশিংটন শহরের এই বিল্ডিংয়েই (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) বসে যখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ঠিক সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে আক্রমণাত্মক ভাষায় বক্তৃতা দিয়েছেন (পার্লামেন্টে)। এবং সরকার পাল্টাতে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রয়েছে বলে দোষারোপ করেছেন। তার ছেলে এবং প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় স্টেট ডিপার্টমেন্টকে একদল ‘ভন্ডের আখড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন। এটা নিয়ে আপনার মন্তব্য কী। আরেকটা সম্পূরক প্রশ্ন করবো যেটা এর আগে আমার এক সহকর্মী এখানে প্রশ্ন করেছেন সে বিষয়ে। আপনি বলেছেন যে, ডয়চে ভেলে এবং নেত্র নিউজ র্যাব নিয়ে যে ডকুমেন্টারি তৈরি করেছে সেটা খতিয়ে দেখছেন এবং বাংলাদেশ সরকারকেও একইভাবে তা তদন্ত করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেটাকে ভিন্ন এক কায়দায় খতিয়ে দেখা শুরু করেছে! তারা ইতিমধ্যে র্যাবরে বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়া একজনকে গ্রেফতার করেছে। এটাই তাদের ভিন্নরকমের খতিয়ে দেখা! এবিষয়ে আপনি কী বলবেন? আরেকটি বিষয়, বাংলাদেশের প্রথম সারির পত্রিকা প্রথম আলোর অফিসে আজ হঠাৎ করেই কিছু লোক নিরাপত্তা ভেঙে তাদের কার্যালয়ে ঢুকে পরে এবং সম্পাদক কোথায় আছে জানতে চায়। তারা হামলা করতেই সেখানে গিয়েছিলো, এটা আপনিও জানেন। এব্যাপারে কী বলবেন?”
জবাবে ভেদান্ত প্যাটেল বলেন, “প্রথমেই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রসঙ্গে বলছি। সর্বশেষ বিশ্বের স্বাধীন গণমাধ্যম সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২। গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের আরও ১০ ধাপ অবনতি হয়েছে। এর বড় একটা কারণ হলো বাংলাদেশের ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। আপনি এর আগেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। বিস্তৃত পরিসরে বলতে গেলে সাংবাদিকদের জন্য পৃথিবীতে যতগুলো কালাকানুন রয়েছে এটি তার মধ্যে অন্যতম একটি। এনিয়ে আমরা খুব স্পষ্ট করে আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছি। মুক্তগণমাধ্যম এবং জনগণের তথ্য সুবিধা পাওয়াটা যেকোনো জাতি এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যম এবং তার ওপর যে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রয়েছে তার প্রভাব নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন।”
তিনি বলেন, “আপনি দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা করেছেন সেটা নিয়ে আমি নতুন কিছু যোগ করছিনা। তবে আবারো যেটার পুনরাবৃত্তি করবো সেটা হলো- মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমরা অবশ্যই আশা করবো বাংলাদেশ সরকার ডয়চে ভেলে এবং নেত্র নিউজের রিপোর্ট এবং ডকুমেন্টারি তদন্ত করবে।”
এর আগে অপর এক সাংবাদিক জানতে চান, “ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানি রিপোর্ট বলছে বাংলাদেশ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নির্যাতন এবং হত্যার সঙ্গে জড়িত। অব্যাহত মানবাধিকার লংঘনের দায়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে সেটা নিয়ে আপনারা কীভাবে অগ্রসর হবেন?”
জবাবে ভেদান্ত প্যাটেল বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার নতুন করে কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে কীনা সেটা নিয়ে আমি এখন কথা বলতে পারবোনা। তবে জোর গলায় যেটা বলবো, গত বৃহস্পতিবারেও তা বলেছি। সেটা হলো-এই (ডয়চে ভেলের) আর্টিকেল এবং ভিডিও আমরা সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখবো। আশা করবো বাংলাদেশ সরকারও একই কাজ করবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।”