৭ ডিসেম্বর (বুধবার) বিএনপি কার্যালয়ে অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া দুই আওয়ামী পুলিশ অফিসার হলেন যুগ্ম কমিশনার (ডিএমপি) মেহেদী হাসান ও বিপ্লব কুমার সরকার। এই দুইজনের নেতৃত্বেই বিএনপি কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে একজনকে হত্যা ও শতাধিক ব্যক্তিকে আহত করা হয়েছে। আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বিএনপি’র সিনিয়র নেতাদের। আওয়ামী ফ্যাসিবাদের অন্যতম সহায়ক এই দুই পুলিশ অফিসার বরাবরই অতি উৎসাহী হিসাবে পরিচিত। বিএনপি কার্যালয়ে হামলা ও নেতাদের আটক করার ঘটনা এটাই তাদের নতুন নয়। ২০১৩ সালে বিএনপি’র কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে এভাবেই দলটির মহাসচিবসহ অনেক সিনিয়র নেতাদের আটক করেছিলেন মেহেদী হাসান। তখন তিনি পুলিশের মতিঝিল জোনের এডিসি ছিলেন। এখন পদোন্নতি পেয়ে মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার।
বিপ্লব কুমার সরকার। কুখ্যাত এক পুলিশ কর্মকর্তার নাম। ছাত্রলীগের কর্মী থেকে বিশেষ একটি মহলের ছত্রছায়ায় হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশ পুলিশের সবচেয়ে প্রতাপশালী কর্মকর্তা। খোদ পুলিশের মহাপরিদর্শক তাঁকে জমাখরচ দিয়ে কথা বলেন।
পুলিশের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও অনুগত আদালতকে ব্যাবহারের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন শেখ হাসিনা। ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশির্বাদপুষ্ট এই দুই চিহ্নিত আওয়ামী পুলিশ কর্মকর্তাকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে রাজধানীতে বিএনপির ১০ই ডিসেম্বরের সমাবেশ বানচাল করতে। সেই নীল নকশার অংশ হিসেবেই মেহেদী হাসান ও বিপ্লব কুমার সরকারের নেতৃত্বে বুধবারের (৭ই ডিসেম্বর) অভিযানে একজনকে হত্যাসহ অনেক মানুষকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। রক্তাক্ত হয়েছে রাজধানীর নয়াপল্টন।
কে এই বিপ্লব কুমার:
চাকুরি জীবনের শুরু থেকে বিপ্লব কুমারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে। ২১তম বিসিএস ক্যাডারে চাকরি নেয়া বিপ্লব সরকার ছিলেন ছাত্রলীগ জগন্নাথ হল শাখার সেক্রেটারি। পুলিশ বিভাগে চাকরি হওয়ার পর নিজের অতীত কৃতকর্মের কথা ভেবে ২০০৩ সালের অক্টোবরে সারদায় ট্রেনিং করেই ডিভি ভিসা পেয়ে আমেরিকায় চলে যান। ৭ বছর আমেরিকায় থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে আসেন। পুলিশের ভাষায়, এসময় তিনি ছিলেন ফেরারি।
কোনো প্রকার অনুমতি ছাড়াই দীর্ঘদিন কর্মস্থলে না থাকায় তার বিরুদ্ধে জিডিও করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ ৭ বছর অনুপস্থিত থেকে দেশে ফিরে রহস্যজনকভাবে ফের চাকরি ফিরে পান তিনি। অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তখন বিপ্লবের স্ত্রী ভারতে পড়াশোনা করতেন। কিছুদিন পর পর তিনি ভারতে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়ে আসতেন।
রংপুর জেলার পুলিশ সুপার থাকাকালীন বিপ্লব কুমার সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে পীরগঞ্জে ২০টির বেশি হিন্দু বাড়ি ও দোকান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এই ঘটনা উন্মোচিত হবার পর তাকে কোন রকমের শাস্তির বদলে সেখান থেকে বদলি করা হয়। ভারতের সহায়তায় একটি বিশেষ মহলের ছত্রছায়া ও আশীর্বাদে এই কর্মকর্তাকে ফের ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বদলি করে আনা হয়।
ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা শুধু পীরগঞ্জেই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাধানোর অপচেষ্টা চালায়নি। ২০১১ সালে তৎকালীন বিরোধী দলের চীফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদীন ফারুককে শেরেবাংলা নগরে সংসদ ভবনের সামনে প্রকাশে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলেন। এই ঘটনটি ঘটেছিল ৬ জুলাই ২০১১ সালে। তখন বিপ্লব কুমার সরকার ছিলেন পুলিশের কর্মকর্তা। শেখ হাসিনার নেক নজরে আসতে বিরোধী দলের তখনকার চিফ হুইপকে হত্যার উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য মিডিয়া ক্যামেরার সামনেই নির্মমভাবে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছিলেন। সেদিন জয়নুল আবেদীনকে পিটানোর সময় তাঁর সাথে ছিলেন আরেক কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন।
জয়নুল আবেদীন ফারুককে পিটিয়ে আহত করার দৃশ্য দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও হয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল বিপ্লব কুমার সরকার জয়নুল আবেদীন ফারুককে বেদম পেটাচ্ছেন। তাদের লাঠির আঘাতে বিরোধী দলের চীফ হুইপের মাথা ফেটে রক্ত ঝরছিল তখন। বুকের ওপর উঠে বুট দিয়ে লাথি মারেন। অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেন। এসময় কয়েকজন মহিলা এমপিকেও আহত করেছিলেন বিপ্লব কুমার ও হারুন।
এই ঘটনার পর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের তখনকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আওয়ামী সন্ত্রাসী হারুন উর রশিদ এবং এসি বিপ্লব কুমার সরকারকে পরের বছর পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছিল শেখ হাসিনার সরকার। হারুন উর রশিদকে পুরস্কার হিসেবে মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার এবং বিপ্লব কুমার সরকারকে একই বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (এডিসি)হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
এরপর একের পর এক অপকর্মের করলেও বিপ্লব কুমার সরকারকে পদোন্নতির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে পদায়ন করেছে শেখ হাসিনার সরকার।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ মহলের চাপে এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে এ পর্যন্ত ২০ বার শ্রেষ্ঠ ডিসি মনোনীত করা হয়েছে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৪ সালে পিপিএম ও ২০১৬ বিপিএম পদক দেওয়া হয়েছে তাঁকে ।
কে এই মেহেদী হাসান:
দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নজিরবিহীন তাণ্ডব চালানোর অভিযানে নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম-কমিশনার মেহেদী হাসান। ৭ ডিসেম্বর নতুন নয়। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে তাঁর নেতৃত্বেই বিএনপি কার্যালয়ে আরেকবার অভিযান চালানো হয়েছিল। কার্যালয়ের ফটকে তালা লাগানো ছিল সেদিন। মই দিয়ে দোতলায় উঠে ভেতরে অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সেদিন মেহেদী হাসান। মহাসচিবসহ অনেক সিনিয়র নেতাকে সেদিনও আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে।
তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে দেশের মানুষ হতবাক। বার বার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপিকে তিনি একাই যেন শেষ করে দিতে চান।
মেহেদী হাসান সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা গেছে, তাঁর দাপটে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারাও থাকেন তটস্থ। হামলা, নির্যাতন, ধরপাকড়, রিমান্ডে নির্যাতন, গ্রেফতার এসবের মাধ্যমে এরই মধ্যে মেহেদী হাসান অতি উৎসাহী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন।
মেহেদী হাসানের বাবার নাম মো. আবদুল মজিদ। বাড়ি খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলার পানতিতা গ্রামে। সরকারি চাকরিজীবী আবদুল মজিদের ৮ ছেলের মধ্যে তৃতীয় মেহেদী হাসান। তার বড় ভাই মারুফ হাসান পুলিশ কর্মকর্তা। অপর ভাইদের মধ্যে একজন সেনাবাহিনীতে, অন্যরাও প্রতিষ্ঠিত। কট্টর আওয়ামী পরিবারের সন্তান মেহেদী হাসানকে পুলিশ বাহিনীতে সবাই জানেন বর্ণচোরা, অতি উৎসাহী ও বেপরোয়া পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে। তার এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন, মেহেদী হাসান ও তার ভাইয়েরা এখন গ্রামের বাড়িতে যান না। এর নেপথ্য কারণ তার মায়ের মৃত্যুর পর বাবা আবদুল মজিদ গৃহকর্মীকে বিয়ে করেন। এ নিয়ে মেহেদী হাসানের ভাইয়েরা বাবার সঙ্গে সম্পর্ক অনেকটাই ছিন্ন করেছেন। মেহেদী হাসানের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন, ছাত্রজীবনে মেহেদী হাসান ছিলেন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী। পুলিশ বাহিনীতে শেখ হাসিনার আত্মীয় শেখ হেলাল গ্রুপের অন্যতম প্রভাবশালী সদস্য তিনি।
শেখ হেলালের প্রভাবে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদেরকেও আঙুলের ইশারায় ঘোরান তিনি।
বিগত কয়েক বছরে বাড়াবাড়ি করে বেশ বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন এই মেহেদী হাসান। বিরোধী দলের মিছিল-মিটিংয়ে গুলি, হামলা, রায়টকার নিয়ে হামলায় একাধিকবার নেতৃত্ব দিয়েছেন কুখ্যাত এই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশ কর্মকর্তা মেহেদী হাসানের অপকর্মের কাহিনী মিছিল-সমাবেশে হামলা আর গুলির মধ্যেই শেষ নয়। তিনি আগে ডিবি পুলিশে ছিলেন। তখন মোহাম্মদ হাসান নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলায় ৯ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। মোহাম্মদ হাসানকে জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ডিবি কার্যালয়ের ছোট রুমে নিয়ে পুরুষাঙ্গে ইলেকট্রিক শক দেয়াসহ নানা কায়দায় তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন তিনি। ওই সময় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এডিসি মেহেদী হাসানের বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাননি মোহাম্মদ। উল্টো মেহেদী হাসান তাকে আবার গ্রেফতার করে একই ভাবে নির্যাতন করবেন বলে হুমকি দেন।
নির্যাতনের পাশাপাশি মোহাম্মদ হাসানের কাছ কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষও নিয়েছিলেন কুখ্যাত এই আওয়ামী পুলিশ।
মোহাম্মদের মতো শত শত নিরপরাধ ব্যক্তি এবং বিভিন্ন মামলার আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করতে নানা কায়দায় নির্যাতন করেছে এই পুলিশ কর্মকর্তা।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এসবের মাধ্যমে মেহেদী হাসান যেমন বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন, তেমনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ক্ষমতাসীন দলের নিপীড়ক ব্যক্তিদের আস্থাভাজন হয়েছেন। তাকে ডেকে নিয়ে প্রতিনিয়ত বিশেষ স্থান থেকে ইন্সট্রাকশন দেয়া হচ্ছে, পাশাপাশি তার পারফরম্যান্সের প্রশংসা করা হচ্ছে।