ঢাকা: ঢাবি শিক্ষকরা বিবেচিত হন দেশের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার পাত্র হিসেবে। দেশে শিক্ষার আলো জ্বালার বাতি থাকে তাদের হাতেই। কিন্তু কতিপয় শিক্ষকের জন্যে এ সম্মান হারাতে বসেছেন ঢাবি শিক্ষকরা। কিছুদিন পরপরই ছাত্রীদের সঙ্গে অনৈতিক যৌন সম্পর্কে জড়িয়ে নিজের, সেই সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেরও মানহানি করছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠছে নিয়মিতই। এ ধরনের ঘটনায় সুষ্ঠু ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের ব্যর্থতায় ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে অনৈতিক কার্যকলাপের ধারা। প্রতিটি ঘটনায়ই তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও বিচার আর হয় না। ফলে একই ঘটনা ঘটছে বারবার।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ২০টিরও বেশি যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ছাত্রীরাই। আবার নিপীড়ক শিক্ষকদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকারাও। প্রতিটি ঘটনারই বিচার দাবি করা হলেও বারবারই বিচার বঞ্চিত হয়েছেন ভুক্তভোগীরা। পার পেয়ে গেছেন ঘটনার হোতা নিপীড়ক শিক্ষকরা। প্রতিটি যৌন হয়রানির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও কোনোটি আলোর মুখ দেখেনি।
ঘটনার সর্বশেষ শিকার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক শিক্ষার্থী। গত ৬ মে ওই বিভাগেরই প্রভাষক আবু নাসের মুহাম্মদ সায়েফের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেন তিনি। লিখিত অভিযোগে তিনি তার সঙ্গে ওই শিক্ষকের প্রতারণার কথা তুলে ধরেন। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কমিটি কাজ শুরু করেনি এখনো।
গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে একই বিভাগের ৩য় বর্ষের এক ছাত্রী। নির্যাতিতা ওই ছাত্রী অভিযোগ করেন, মিডটার্ম পরীক্ষায় খাতায় সমস্যা হয়েছে- এমন কথা বলে শিক্ষক তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছেন। এই ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষককে ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠক ডেকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়।
২০১২ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মাহমুদুর রহমানের (বাহলুল) বিরুদ্ধে বিভাগেরই এক ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠে। ওই ঘটনায় তাকে সহায়তার অভিযোগ উঠে বিভাগের অন্য দুইজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ওই বছরই ছাত্রীর যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠে সমাজকল্যাণ বিভাগের পরিচালকের বিরুদ্ধে।
একই বছরের ১৫ অক্টোবর আরবি বিভাগের অধ্যাপক এটিএম ফখরুদ্দিনের বিরুদ্ধে ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে উঠে। তিনি এক ছাত্রীকে জোর করে বিয়ে করেন এমন অভিযোগ উঠেছিল। এ ঘটনায় তাকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে আরবি বিভাগের শিক্ষকরাসহ সাধারণ ছাত্ররা তাকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করে।
২০১২ সালে যৌন হয়রানি ও পরীক্ষায় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ উঠে মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মাহমুদ হাসানের বিরুদ্ধে । একই বছর পরিসংখ্যান, প্রাণ পরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাফর আহমেদ খানের বিরুদ্ধে বিভাগের ছাত্রী, ব্যাংক কর্মকর্তা ও বাইরের মেয়েদের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক, মাসের পর মাস বিভাগের ছাত্রীদের নিয়ে বাসায় থাকার অভিযোগ উঠে ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এমরান হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলে একই বিভাগের এক ছাত্রী। একই বছরের প্রথম দিকে উর্দু বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. ইস্রাফিলের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগে তুলেন বিভাগেরই এক ছাত্রী। তার বিরুদ্ধে এর আগেও বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন করার অভিযোগ পাওয়া যায়।
২০১১ সালের জুনে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক মুমিত আল রশিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা ও নির্যাতনের অভিযোগ করে বিচার দাবি করেন এক ছাত্রী। একই বিভাগের আরেক সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু মুসা আরিফ বিল্লাহকে ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠায় ঢাবি প্রশাসন।
একই বছর পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ছাত্রী লাঞ্ছনার অভিযোগ ওঠলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
২০১১ সালের শেষের দিকে উর্দু বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মাহমুদুল ইসলামের বিরুদ্ধে একই বিভাগের এক ছাত্রীর সঙ্গে অবৈধ সম্পকের অভিযোগ ওঠে। একই বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নুরুদ্দীন আলোর বিরুদ্ধে যৌতুকের দাবিতে স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগে মামলা করা হয়।
২০১০ সালে উর্দু বিভাগের প্রভাষক গোলাম মাওলার হিরণের বিরুদ্ধে একই বিভাগের এক ছাত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগ ওঠে। একই বছর ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আফজাল হোসেনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনে আন্দোলনে নামে বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
২০০৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন মোল্লার বিরুদ্ধে এক ছাত্রী যৌন হয়রানির অভিযোগ আনে।
বাদ পড়েননি ঢাবির শিক্ষিকারাও। ২০১০ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক সিনিয়র অধ্যাপকের বিরুদ্ধে একই বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. শওকত আরা তার সঙ্গে অশালীন আচরণের অভিযোগ করেন।
প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রেই তদন্ত কমিটির দেখা মিলেলে। তবে দেখা মেলেনি বিচারের। এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি কোন ব্যবস্থাই নিতে পারেনি। প্রতিটি ঘটনায় চাপা পড়ে গেছে। তাই একের পর এক এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে।
২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিলে অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলমকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে এ কমিটিও আলোর মুখ দেখেনি এখন পর্যন্ত। যৌন নিপীড়নের এতো অভিযোগের বিরুদ্ধে সফলভাবে কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি এ কমিটি।
এসব ঘটনায় বিচারের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রক্টর অধ্যাপক ড. আমজাদ আলী বাংলামেইলকে বলেন, ‘এসব ঘটনায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। তারাই এগুলো দেখে থাকে। অনেক লম্বা প্রক্রিয়া হওয়ায় বিচারে অনেক সময় লেগে যায়। তবে আমি মনে করি, এ ধরনের ঘটনায় যারা জড়িত থাকে তাদের সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত। আশা করি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ড. নাসরীন আহমদ বলেন, ‘আমি মনে করি এসব ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও সমভাবে দায়ী। একটি মেয়ে কোন ধরনের পারিবারিক সম্পর্কে জড়ানোর আগেই কেন আরেকজন শিক্ষকের সঙ্গে নেপাল পর্যন্ত চলে যাবে। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষকদেরও আরো দায়িত্ববান হওয়া উচিত। এধরনের প্রতিটি ঘটনায় আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। কিন্তু খুব দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত তো নেয়া যায় না। একজন শিক্ষককে আমরা তাৎক্ষণিক বহিস্কার করে দিতে পারি না, তবে তাকে আমরা বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে দিতে পারি।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বাংলামেইলকে বলেন, ‘একেবারে বিচার হয়নি, এটি বলা ঠিক হবে না। কোন ধরনের তদন্ত ছাড়া তো কাউকে বহিস্কার করে দেয়া যায় না, তবে আমরা অনেককেই বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছি।’
তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ সব ঘটনায় তিন পর্যায়ে তদন্ত করা হয়। তিন ধাপে তদন্ত করার পর চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়। তদন্ত চলছে, তদন্ত চলাকালীন সময়ে কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এসব ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি হচ্ছে চাকরিচ্যুতি।’