বিনিয়োগ ও পানিতে গুরুত্ব দিচ্ছে ঢাকা

0

tistaপশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার আগে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনায় কোনো অগ্রগতি সম্ভব নয়—এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশই চাইছে আপাতত এই চুক্তিতে আটকে না থেকে অন্যান্য বিষয়ে সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
তবে বাংলাদেশ গুরুত্ব দিচ্ছে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার ওপর। পাশাপাশি সমুদ্র অর্থনীতি, বিনিয়োগসহ অন্য খাতে সহযোগিতা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। আর ভারত বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও যোগাযোগসহ অন্য খাতে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়।
এ মাসের শুরুতে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের আলোচনায় দুই দেশ এমন অবস্থান তুলে ধরেছে। দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকটি ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় নেওয়া সিদ্ধান্তের পর্যালোচনা সভা। হাসিনা-মোদি শীর্ষ বৈঠকের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গত আট মাসের অগ্রগতিতে দুই পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করে।
নয়াদিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র গত রোববার প্রথম আলোকে জানিয়েছে, দুই দেশের সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশ এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক (জেসিসি) আয়োজন করতে আগ্রহী। গত বছরের জুনে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের কারণে ওই বৈঠকটি হতে পারেনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের আগে দুই দেশ মার্চে ঢাকায় অন্তত তিনটি বৈঠক আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ তিনটি বৈঠকের মধ্যে রয়েছে যৌথ সীমান্ত কার্যকরী দল, সমুদ্র অর্থনীতিবিষয়ক যৌথ কারিগরি কমিটি ও বাংলাদেশে ভারতের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিশেষজ্ঞ কমিটির সভা।
বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানান, ১ ফেব্রুয়ারি দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করের বৈঠকটি ছিল ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের পর দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রথম বৈঠক। দেড় ঘণ্টার বৈঠকটিতে দুই দেশের সম্পর্কের সবগুলো বিষয় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়নি। তবে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি ও সীমান্তে বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র লোকজনের প্রাণহানি বন্ধের মতো ঢাকার অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে।
জানতে চাইলে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতি ভালো। এ ছাড়া ভবিষ্যতে অন্য ক্ষেত্রগুলোতে আমরা সহযোগিতা জোরদারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের সাম্প্রতিক আলোচনায় অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন প্রশ্নে খুব সংগত কারণেই এসেছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সইয়ের প্রসঙ্গটি। এ সময় ভারত তার অঙ্গীকারের বিষয়টি আবারও ব্যক্ত করেছে। সেই সঙ্গে সরকারের কর্মপদ্ধতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোনো চুক্তি সইয়ের ক্ষেত্রে সীমান্তবর্তী রাজ্যকে আস্থায় নেওয়ার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের আগে (এপ্রিলে শুরু হয়ে মে মাসে শেষ হবে) তিস্তার পানি বণ্টনে কোনো চুক্তি সই হচ্ছে না। এ মুহূর্তে এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া ছাড়া বাংলাদেশের তেমন কিছু করারও নেই।
তিস্তা নিয়ে শিগগিরই কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা না থাকায় যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ তেমন আগ্রহী নয়। কারণ, পাঁচ বছর বিরতির পর জেআরসির বৈঠক হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই তিস্তার প্রসঙ্গ আসবে। কিন্তু দুই দেশই বুঝতে পারছে, এ মুহূর্তে তিস্তা নিয়ে চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই জেআরসির বৈঠকে কোনো ফলাফল না এলে জনসমক্ষে এবং গণমাধ্যমে দুই দেশ সমালোচিত হবে। আপাতত দুই দেশ এই পরিস্থিতির মুখে পড়তে চায় না।
এমন এক পরিস্থিতিতে পানিবণ্টনে সহযোগিতার ক্ষেত্রে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি দিল্লির সাম্প্রতিক আলোচনায় তুলেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে গত মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আওতায় পানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বৈঠকে অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব দেয় ঢাকা। দিল্লির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে সমীক্ষা করা হবে। এ বছরের মধ্যেই সমীক্ষা শুরু করতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ ও ভারত। সমীক্ষা শুরুর আগে ভারতের একটি প্রতিনিধিদল আলোচনার জন্য ঢাকায় আসবে।
জানতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, কৌশলগত চিন্তা হিসেবে এটি করা যেতে পারে। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক মানেই দেওয়া-নেওয়া। সেখানে দেওয়া বা নেওয়া একপেশে হলে সম্পর্ক সুষম হয় না। তা ছাড়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবগুলো বিষয়ে সমস্যা সমাধানের জন্য লক্ষণীয় চেষ্টা থাকা বাঞ্ছনীয়।
সীমান্ত হত্যা ও জাল মুদ্রা প্রসঙ্গ: অন্যান্যবারের মতো এবারও সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধের বিষয়টি পররাষ্ট্রসচিবদের বৈঠকে বাংলাদেশ জোরালোভাবেই তুলেছে। এ প্রসঙ্গে ভারত আবারও হত্যাকাণ্ডের সময়ের প্রসঙ্গটি এনেছে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর বেশির ভাগই ঘটছে রাতে। আর এসব ঘটনার শিকার হওয়া লোকজন কোনো না কোনোভাবে চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত, এটিও ভারত জোরালোভাবেই বলছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ বলছে, সীমান্তে রাতে কোনো লোক অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে তাকে দেখামাত্র গুলি না করে রাবার বুলেট ব্যবহারের মতো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
জানা গেছে, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে পররাষ্ট্রসচিবের বৈঠকে দুই দেশের নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদারের প্রসঙ্গ এসেছে। এ সময় দুই দেশের মধ্যে এখন যে সহযোগিতা রয়েছে, তা নিয়ে দুই পক্ষ সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সীমান্ত হয়ে জাল ভারতীয় মুদ্রা সে দেশে প্রবেশের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগের কথা জানান অজিত দোভাল। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপের প্রসঙ্গ টেনে শহীদুল হক বলেন, জাল ভারতীয় মুদ্রা পাচার রোধের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে।
অন্যান্য: সীমান্ত চুক্তি ও উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তির বাস্তবায়ন, ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চালু এবং ঋণচুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা করে দুই পক্ষ তাদের সন্তোষের কথা জানিয়েছে সাম্প্রতিক আলোচনায়। প্রথম ঋণচুক্তির ১৫টি প্রকল্পের সাতটি বাস্তবায়িত হওয়াকে দুই পক্ষ যৌক্তিক মনে করছে। কারণ, প্রথমবারের মতো এ ধরনের ঋণ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শুরুতে প্রকল্প চূড়ান্ত করাসহ প্রক্রিয়াগত কারণে কিছুটা সময় লেগেছে। ওই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার ২০০ কোটি ডলারের দ্বিতীয় ঋণচুক্তির প্রকল্পগুলো আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন চুক্তিটি সইয়ের পর ঋণের আওতায় ১৩টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে।
থমকে আছে তিস্তা চুক্তি: ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তি সইয়ের জন্য চূড়ান্ত হয়েছিল। দুই দেশের প্রবাহের অংশ কী হবে, সেটি বাদ দিয়ে চুক্তিটির খসড়া তৈরি হয়েছিল। মনমোহন ঢাকায় আসার আগের দিন বেঁকে বসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে না জানিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট (ইউপিএ) চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছে—এ অজুহাতে তিনি তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করে মনমোহনের সফরসঙ্গী হিসেবে ঢাকায় আসেননি। পরে অবশ্য কংগ্রেস সরকার তাঁকে কয়েক দফা বোঝানোর চেষ্টা করেছে। মমতা তিস্তা নিয়ে চুক্তি সইয়ের আগে নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে দিয়েও কমিশন করান। শেষ পর্যন্ত রুদ্র কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও তাতে সন্তুষ্ট হননি মমতা। ওই প্রতিবেদনে নদীর জন্য একটা অংশ পানি রেখে বাকিটা দুই দেশের জন্য ভাগাভাগির প্রস্তাব দেন কল্যাণ রুদ্র। তবে ওই প্রতিবেদন বিবেচনায় নিলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গের লোকজন কতটা পানি পাবে—এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সেই সঙ্গে রাজ্যের বিধানসভার ভোটেও এটি একটি ইস্যু হবে। এসব বিবেচনায় ঝুলে আছে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের ভাগ্য।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More