‘মধ্যবিত্ত শ্রেণি তলার দিকে নামলে সামাজিক সংঘাত অনিবার্য’

0

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। অর্থনীতিবিদ। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। সাবেক চেয়ারম্যান, জনতা ব্যাংক।

১৯৭৮ সালে তিনি মস্কোর মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে অর্থনীতি বিষয়ে এমএসসি ও ১৯৮২ সালে উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষকতায় যোগ দেন ১৯৮২ সালে।

আমি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করছি না। আমি বাংলাদেশকে বাংলাদেশের সঙ্গেই তুলনা করতে চাই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে কোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলাদেশে তলার দিকে নেমে যাচ্ছে।

দুর্ভিক্ষ সম্পর্কিত সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, দেশের অর্থনীতির সংকট ও ভবিষ্যৎ প্রসঙ্গে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। চলমান সংকটের জন্য অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর দুর্নীতিকেও দায়ী করেন তিনি।

তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষ পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

প্রথম পর্ব: ‘ক্ল্যাসিক্যাল দুর্ভিক্ষ বলতে যা বোঝায় তা হবে না’

দ্বিতীয় পর্ব: ‘রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হলে রাষ্ট্রও দুর্বল হয়ে যায়’

ঢাকা শহরই তো গোটা বাংলাদেশ নয়। আপনি এমন উন্নয়ন করে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে এনে জ্যামে আটকে দিচ্ছেন কেন? আপনি গ্রামের উন্নয়ন করেন। মানুষ গ্রামে চলে যাবে। আপনার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল করতে হবে কেন?

জাগো নিউজ: অর্থনৈতিক সংকটের নানা কারণ উল্লেখ করেছেন আগের দুই পর্বে। সামনে কী অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য?

আবুল বারকাত: প্রথমত, মধ্যবিত্ত শ্রেণি তলার দিকে নেমে যাবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তলার দিকে নামলে সামাজিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে যাবে। ইতিহাস তাই বলে। বলা হচ্ছে যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের কোনো বিকল্প নেই। আবার বিরোধীশক্তিও বলছে তাদের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসটাই তো এরকম।

দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি বাংলাদেশকে এমন জায়গায় নিয়ে গেছে যা নিয়ন্ত্রণ করার আপাতত কোনো সমাধান আছে বলে মনে করি না। এটি সামাজিক সংকটকে আরও তীব্র করে তুলছে।

জাগো নিউজ: শ্রীলঙ্কা-পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেও অনেকে আলোচনা করছেন। আসলে কি তুলনা করা যায়?

মধ্যবিত্ত শ্রেণি তলার দিকে নেমে যাবে। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তলার দিকে নামলে সামাজিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে যাবে। ইতিহাস তাই বলে। বলা হচ্ছে যারা ক্ষমতায় আছে, তাদের কোনো বিকল্প নেই। আবার বিরোধীশক্তিও বলছে তাদের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসটাই তো এরকম।

আবুল বারকাত: আমি আসলে পাবলিক আয়োজনে আর থাকছি না। এটি আমার জন্য সুবিধা হয়েছে। আমি বেশি করে চিন্তা করতে পারছি।

আমি বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করছি না। আমি বাংলাদেশকে বাংলাদেশের সঙ্গেই তুলনা করতে চাই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে কোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি বাংলাদেশে তলার দিকে নেমে যাচ্ছে।

জাগো নিউজ: কেন এমনটি মনে করছেন?

আবুল বারকাত: রেমিট্যান্স খুব ভালো অবস্থায় নেই। বলা হচ্ছে, গত দুই বছরে দুই লাখ শ্রমিক বিদেশে গেছে। কিন্তু সেই তুলনায় তো রেমিট্যান্স বাড়েনি। ডলারের সংকটের কারণেই প্রবাসীরা লোকসান করে টাকা পাঠাতে চাইছেন না। কারণ তাদের আয় অত্যন্ত পরিশ্রমের।

জাগো নিউজ: এখানে কোনো উপায়?

আবুল বারকাত: ডলারের সমস্যা দূর করতে হবে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সঙ্গে ডলারের পার্থক্য যেন ১ বা ২ টাকা থাকে। সরকার চাইলে এটি করতে পারবে। কোনো অসুবিধা নেই।

বাংলাদেশে সব মিলে প্রায় ১২ হাজার ব্যাংক শাখা রয়েছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ এডি ব্রাঞ্চ। এসব ব্রাঞ্চে ডলারের কারবার হয়। ধরলাম, প্রতি ব্রাঞ্চে পাঁচজন দালাল আছে, যারা ডলার কেনা-বেচার নিয়ন্ত্রণ করে। সরকার চাইলেই এই দালালদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে তো তাড়ানো সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত হচ্ছে, রপ্তানি আয়। রপ্তানি আয়ের অবস্থাও ভালো নয়। সামনে বিদ্যুতের উৎপাদন আরও কমবে। উৎপাদন কমলে রপ্তানি কমে যাবে। রেমিট্যান্স আর রপ্তানি কম থাকলে রিজার্ভ আরও কমে যাবে।

রিজার্ভ যে আসলে কত, সেটাও মানুষ জানে না। ফরেন কারেন্সি আসলে রিজার্ভ নয়। এটি বিনিয়োগের মধ্যে পড়ে। প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার হচ্ছে ফরেন কারেন্সি। ৩৫ বিলিয়ন থেকে ৯ বিলিয়ন বাদ দিতে হবে।

হয়তো বলবে, তিন বা পাঁচ বিলিয়ন থাকলেও আমরা খারাপ করিনি। কিন্তু এটি অনেক বছর আগের কথা। সবকিছু দেখে মনে হয়েছে ম্যাক্রো (সামষ্টিক) ইকোনমি বলতে যা বোঝায়, তা খুব বুদ্ধিদীপ্ত ব্যবস্থাপকদের হাতে নেই।

ম্যাক্রো (সামষ্টিক) আর মাইক্রো (ব্যষ্টিক) অর্থনীতির মধ্যে একটি গরমিল আছে। কারণ সামষ্টিক হিসাবে হাজার হাজার কোটি টাকা দেখানো হচ্ছে। অথচ অর্থনীতির অবস্থা ভালো নেই। আমরা মাইক্রো অর্থনীতি তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এ বিষয়টি তো আমাদের অ্যাড্রেস করতে হবে।

জাগো নিউজ: তার মানে প্রকৃত উন্নয়ন…

আবুল বারকাত: আপনি নিজে কী সামনের দিনে ভালো কিছু দেখছেন?

অনিশ্চয়তার মতো বাজে কোনো রোগ নেই। ক্যানসার তত বাজে রোগ নয়, যতটা বাজে অনিশ্চয়তা। আপনি আরও কষ্ট করতে রাজি আছেন। কিন্তু আপনার সে কষ্টের ফল পাওয়ার তো নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আগে একটি পরিবারে দুজন কাজ করলেই ভালো থাকতে পারতো। এখন সবাই কাজ করেও ভালো থাকতে পারছে না। তাহলে উন্নয়ন গেলো কোথায়? উন্নয়ন জিনিসটা আসলে কী?

বড় একটি ফ্লাইওভার বা চার লেনের রাস্তা করলেই কি উন্নয়ন? বড় বড় ভবন দেখলেই আমি তৃপ্ত হতে পারি না। আমার কাছে উন্নয়ন আর তাদের সংজ্ঞায়িত উন্নয়ন এক নয়।

ঢাকায় এমআরটি হচ্ছে। তাতে গ্রামের কৃষকের কী লাভ? এ লাভের কথা শহরবাসীও জানে না। আমরা বারবার বলছি, ঢাকা শহরে ট্রাফিক জ্যামের কারণে এত এত কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। এটি সহজেই বোঝা যায়। এক সময় অর্থমন্ত্রী মুহিত সাহেব বলেছিলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকা শহরই তো গোটা বাংলাদেশ নয়। আপনি এমন উন্নয়ন করে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে এনে জ্যামে আটকে দিচ্ছেন কেন? আপনি গ্রামের উন্নয়ন করেন। মানুষ গ্রামে চলে যাবে। আপনার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল করতে হবে কেন?

সরকার এখন বলছে, গ্রাম হবে শহর। গ্রাম আপনি শহর করবেন কেন? কে বলছে আপনাকে শহর বানাতে?

ঝুঁকি অনুমান করা যায়, কিন্তু জীবনের অনিশ্চয়তা অনুমান করা যায় না। মানুষ তাহলে কত বিপদে আছে সহজেই বোঝা যায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলে ভালো রাখার স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আমি তো সে স্বপ্ন দেখবো না। আমি বাস্তব পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। মানুষ অনিশ্চয়তায় রয়েছে দেখতে পাচ্ছি।

জাগো নিউজ: আজকের এই সংকটের জন্য উন্নয়ন নীতিকেও দায়ী করা যায়?

আবুল বারকাত: আমরা মূলত ভৌত কাঠামোর উন্নয়নে জোর দিয়েছি। আমরা মানবিক উন্নয়নে জোর দিতে পারিনি।

মানবিক উন্নয়নের বিষয় হচ্ছে তিনটি। প্রথমত, স্বাস্থ্য। দ্বিতীয়ত, শিক্ষা। তৃতীয়ত, কাজ। বাংলাদেশে প্রায় ৯০ হাজার গ্রাম রয়েছে। আমিও মেগা প্রকল্পের পক্ষে। কিন্তু সেই মেগা প্রকল্প ঠিক আলাদা। ৯০ হাজার গ্রামে ক্যানসার, কিডনি, হৃদরোগ আর ডায়বেটিসের রোগী কে কে আছেন তাদের চিহ্নিত করে বের করতে হবে। আমি দায়িত্ব পেলে মাত্র তিন ঘণ্টায় সব খুঁজে বের করতে পারবো। এরপর তাদের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা। এর চেয়ে তো বড় প্রজেক্ট হতে পারে না। ৫৭৬টি মডেল মসজিদ করা গেলো অথচ গ্রামে কোনো মডেল স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা স্কুল করা গেলো না। তার মানে উন্নয়নের সংজ্ঞায় সমস্যা আছে।

বলা হচ্ছে অবকাঠামোর উন্নয়ন আগে, মানবিক উন্নয়ন পরে। আর আমি বলছি, মানবিক উন্নয়নের প্রয়োজনে অবকাঠামো উন্নয়ন। অবকাঠামো উন্নয়ন করলেই মানুষের ক্যানসার সেরে যাবে না। পদ্মা সেতুর কারণে অনেক রোগী ঢাকায় আসতে পারছে। সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে তাকে ঢাকায় আনতে হবে কেন? চিকিৎসার ব্যবস্থা তো পদ্মার ওপারেই করার কথা ছিল। আপনি সব কিছুই টাকার হিসাব করতে পারবেন না। জীবনের মৌলিক বিষয়গুলো টাকার অংকে মেলানো যায় না।

একটি ভালো প্রাথমিক বিদ্যালয় যদি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে এর মূল্য কখনই নির্ধারণ করতে পারবেন না। গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য ভালো রাখলে দেশ কত উপকৃত হবে তার মূল্যায়ন রাষ্ট্র করতে পারে না। প্রতিরোধ আর প্রতিষেধকের মধ্যকার তফাৎ বুঝতে হবে। একটু বৃষ্টি হলেই সুয়ারেজ আর ওয়াসার লাইন এক হয়ে যায়। কে কার কথা শোনে। শত শত মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে! কি সমাধান দিচ্ছেন মেয়র?

উৎসঃ জাগোনিউজ

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More