মহান মে দিবস আজ বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বিশ্বব্যাপী

0

may dayমালিক কর্তৃক শ্রমিকদের বঞ্চনা যুগে যুগে দেশে দেশে নানাভাবে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। শ্রমিকদের জীবন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে মালিকদের অবহেলা নতুন কিছু নয়। সভ্যতার কারিগর হয়েও নাগরিক সুযোগ-সুবিধায় তারা থাকে উপেক্ষিত। এ বঞ্চনার ইতিহাস যেমন উন্নত বিশ্বের, আবার বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত কিংবা অনুন্নত দেশেরও রয়েছে। স্পেকট্রা, ফিনিক্স, তাজরিন কিংবা রানা প্লাজা দুর্ঘটনা সেই ইতিহাসেরও একেকটি কালো অধ্যায়।
এই নিরাপত্তাহীনতা আর বঞ্চনা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মহান মে দিবস। আজ সেই মে দিবস। এই দিবসের কল্যাণেই আজ শ্রমিক ইস্যু কোনো দেশের কিংবা প্রতিষ্ঠানের একক ইস্যু নয়। আর এ কারণেই বাংলাদেশে কোনো শ্রমিক নির্যাতন হলে তার প্রভাব পড়ে বিশ্ববাজারে। ঠিক যেমন রানা প্লাজা ধসের ইস্যুতে সারাবিশ্বে শ্রমিক নিরাপত্তা এখন প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘নিরাপত্তা চাই’ এখন বিশ্বের প্রতিটি শ্রমিকের স্লোগানে পরিণত হয়েছে।
তবে প্রতি বছর মে দিবস পালন করা হলেও আজও উপেক্ষিত তাদের অধিকার। মধ্যযুগের সেই দাশপ্রথা হয়তো এখন নেই, কিন্তু শ্রমিকদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, জীবন ধারণে ন্যূনতম প্রয়োজনের চেয়ে কম মজুরি, চাকরি থেকে বিনা নোটিশে অপসারণসহ নানা কৌশল ও মাত্রায় বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন তারা। প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তাসহ কিছু সুবিধা ভোগ করলেও গৃহশ্রমিকসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের কথা অনালোচিতই থেকে যায়। তাদের অধিকারের কথা তারা নিজেরাই জানে না। মে দিবসের খবরও পৌঁছে না তাদের কাছে।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিক বলতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক এখন পোশাক খাতে। এর মধ্যে আবার অধিকাংশই নারী। এই নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। এ ছাড়া স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাতেও তারা পিছিয়ে রয়েছে। তবে বিশ্ববাজারের চেইনের অংশ হওয়ায় এই শিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে রানা প্লাজা ধসের পরে। আর এই সচেতনতার কারণে কর্মপরিবেশের কিছুটা উন্নতি হয়েছে এবং হচ্ছে। ক্রেতাজোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের পরিদর্শন ও সংস্কার কার্যক্রম চলছে। পাশাপাশি বিজিএমইএ ও সরকারও বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সর্বশেষ পোশাক শ্রমিকদের জন্য একটি তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য সব খাতের শ্রমিকদের জন্যও নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলো। বিশেষ করে কর্মপরিবেশের উন্নতির পাশাপাশি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার টাকা করার দাবি তাদের। বর্তমানে পোশাক খাতে ৫ হাজার ৩০০ টাকা দেয়া হয় নূন্যতম মজুরি হিসেবে। এ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, কথায় কথায় ছাঁটাই না করা, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন বন্ধের দাবি সংগঠনগুলোর।
মে দিবসের ইতিহাস: দীর্ঘ বঞ্চনা আর শোষণ থেকে মুক্তি পেতে ১৮৮৬ সালের এদিন বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলেন শ্রমিকরা। সেদিন শ্রমিকরা আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন। সে ডাকে শিকাগো শহরের তিন লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন। শ্রমিক সমাবেশকে ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকের বিক্ষোভ সমুদ্রে। এক লাখ পঁচাশি হাজার নির্মাণ শ্রমিকের সঙ্গে আরো অসংখ্য বিক্ষুব্ধ শ্রমিক লাল ঝাণ্ডা হাতে সমবেত হন সেখানে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ১০ শ্রমিক প্রাণ হারান।
অন্যদিকে হে মার্কেটের ওই শ্রমিক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার। পরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ‘মে দিবস’ নামে পালিত হতে শুরু করে।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা, মিছিল ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। আজ সরকারি ছুটি। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব তফসিলি ব্যাংক ও কলকারখানা বন্ধ থাকবে। সংবাদপত্র কার্যালয়ে ছুটি থাকায় আগামীকাল দেশে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ হবে না। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও বেতারগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
আজকের কর্মসূচি: বিভিন্ন রাজনৈতিক, শ্রমিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দল ও সংগঠন মে দিবস উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কর্মসূচিতে আছে পতাকা উত্তোলন, শোভাযাত্রা, লাল পতাকা মিছিল, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, গণসঙ্গীত, নৃত্যানুষ্ঠান, নাটক, কবিতা পাঠ, আলোকচিত্র, চিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদি।
প্রতি বছরের মতো এবারো রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল সাড়ে ৭টায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালির আয়োজন করা হয়েছে। র‌্যালিটি দৈনিক বাংলা থেকে শুরু হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হবে। র‌্যালির উদ্বোধন করবেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। এদিকে মে দিবস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বিকেল ৪টায় আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেবেন।
এ দিবস উপলক্ষে শ্রমিক সমাবেশ করবে বাংলাদেশ জাতীতাবাদী শ্রমিক দল। বেলা ২টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া বেলা ৩টায় কাকরাইলস্থ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শ্রমিক পার্টির উদ্যোগে এক শ্রমিক সভায় বক্তব্য রাখবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওযার্কার্স পার্টি, জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, গণসংস্কৃতি ফ্রন্ট, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগ, টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, গ্রিনবাংলা গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন, সামাজিক, পেশাজীবী এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে র‌্যালি, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এ ছাড়া শিল্প এলাকাগুলো আশুলিয়ায় ফ্যান্টাসি কিংডমের সামনে, গাজীপুর বড়বাড়ী, তেজগাঁও, নাবিস্কো শহীদ মিনারের সামনে ও মিরপুর সেনপাড়ায় বিকেল ৪টায় শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More