দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ভারতের চার রাজ্য আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সীমানারেখা পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশের বর্তমান মানচিত্র খানিক বদলে যাবে। এ চুক্তির ফলে ভারতের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলো ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে আর বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ছিটমহলগুলো যুক্ত হবে বাংলাদেশের সঙ্গে।
২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এতে উভয় দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়সহ সীমান্তের বেশ কয়েকটি অংশে পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিটমহল বেশি হওয়ায় নতুন মানচিত্রে দেশের আয়তন কিছুটা বাড়বে।
প্রটোকলের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের প্রথম অংশে ‘মুহুরী নদী (বিলোনিয়া) সেক্টর’ শিরোনামে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সীমানা পিলার (২১৫৯/৪৮-এস) থেকে সীমানারেখা আরও পশ্চিম দিকে টেনে ১৯৭৭-৭৮ সালের যৌথ সমীক্ষার ভিত্তিতে তৈরি মুহুরী নদী এলাকার নকশায় প্রদর্শিত বার্নিংঘাটের দক্ষিণ সীমায় গিয়ে মিলবে।
এরপর তা উত্তর দিকে বাঁক নিয়ে বার্নিংঘাটের বাইরের সীমা বরাবর গিয়ে বর্তমান মুহুরী নদীর কেন্দ্রে মিশবে। এটি আবার বিদ্যমান মুহুরী নদীর মধ্যস্রোত বরাবর গিয়ে ২১৫৯/৩-এস সীমান্ত পিলার পর্যন্ত যাবে। এটি হবে স্থায়ী সীমানা। ১৯৭৪ সালের চুক্তি অনুযায়ী নদীর বর্তমান ধারা স্থিতিশীল রাখতে উভয় দেশের সরকারের নিজ নিজ অংশে বাঁধ দেওয়া উচিত বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, এই সীমান্তের শূন্যরেখায় বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে উভয় পক্ষ।
তৃতীয় অংশে ‘লাঠিটিলা ও ডুমাবাড়ী’ শিরোনামে র্যাডক্লিফের (১৯৪৭ সালের ভারত-পাকিস্তান সীমানা চিহ্নিতকরণ কমিশনের প্রধান স্যার সিরিল র্যাডক্লিফ) আঁকা সীমানারেখা ১৩৯৭ নম্বর পিলার থেকে সোজা দক্ষিণে ডুমাবাড়ী, লাঠিটিলা ও বড় পুটনিগাঁও মৌজার লোহার ব্রিজ পর্যন্ত এবং এরপর তা দক্ষিণ দিকে পুটনিছড়া বরাবর সিলেট-ত্রিপুরা সীমান্ত পর্যন্ত (পিলার নম্বর ১৮০০) টানার কথা বলা হয়েছে।
চতুর্থ অংশে ‘দইখাটা ৫৬ (পশ্চিমবঙ্গ-জলপাইগুড়ি)/পঞ্চগড়’ শিরোনামে বলা হয়েছে, এই অংশের স্থায়ী সীমান্তরেখা ১৯৯৭-৯৮ সালের জরিপ অনুযায়ী দইখাটা ৫৬-এর সীমানা বরাবর ৪৪৪/৬ নম্বর সীমান্ত নকশায় (স্ট্রিপশিট) বিদ্যমান ৭৭৪/৩২-এস সীমান্ত পিলার থেকে শুরু হবে। এরপর তা দইখাটা ৫৬-এর (পূর্ব থেকে পশ্চিম) দক্ষিণ সীমানা অনুসরণ করে ১৮ নম্বর পয়েন্ট পর্যন্ত যাবে।
এরপর তা আবার দইখাটা ৫৬-এর (দক্ষিণ থেকে উত্তর) পশ্চিম সীমানা অনুসরণ করে ১৫ নম্বর পয়েন্টে সুই নদীর মাঝে গিয়ে মিশবে। ওই সীমান্তরেখা আবার সুই নদীর মাঝ বরাবর গিয়ে ২০১১ সালের ৩ আগস্ট যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে প্রস্তুত সীমান্ত নকশা অনুযায়ী ১ নম্বর পয়েন্টে গিয়ে মিশবে।
এরপর ৭৭৫ নম্বর মূল পিলারের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আঁকা সীমান্ত অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সীমান্ত নির্ধারিত হবে। প্রটোকলের তৃতীয় অনুচ্ছেদে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও আসাম সেক্টরে অপদখলীয় ভূমির সীমানা প্রসঙ্গে।
এতে বলা হয়, ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১১ সালের আগস্ট পর্যন্ত উভয় দেশের ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরের যৌথ উদ্যোগে চূড়ান্ত করা অপদখলীয় ভূমির নকশা অনুযায়ী অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের মাধ্যমে স্থায়ী সীমান্ত নির্ধারিত হবে।
তৃতীয় অনুচ্ছেদে ‘পশ্চিমবঙ্গ সেক্টর’ শিরোনামে ছয়টি এলাকার সীমান্তের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। বোসমারী-মাধুগারি (কুষ্টিয়া-নদীয়া) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও ২০১১ সালের জুন মাসে দুই দেশের সম্মতি অনুযায়ী এ সীমান্ত ১৯৬২ সালের মানচিত্র অনুসারে ১৫৪/৫-এস সীমানা পিলার থেকে শুরু করে মাথাভাঙ্গা নদীর পুরনো ধারা অনুসরণ করে ১৫১/১-এস নম্বর সীমান্ত পিলারে গিয়ে মিশবে।
আন্ধারকোটা (কুষ্টিয়া-নদীয়া) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও ২০১১ সালের জুনে দুই দেশের সম্মতি অনুযায়ী এ সীমানা ১৫২/৫-এস নম্বর পিলার থেকে টেনে বর্তমান মাথাভাঙ্গা নদীর কূল অনুসরণ করে ১৫৩/১-এস নম্বর সীমান্ত পিলার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
পাকুরিয়া (কুষ্টিয়া-নদীয়া) এলাকা প্রসঙ্গে প্রটোকলে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও ২০১১ সালের জুন মাসে দুই দেশের সম্মতি অনুযায়ী এ সীমানারেখা ১৫১/১-এস নম্বর পিলার থেকে টেনে ১৫২/২-এস নম্বর সীমান্ত পিলার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
চর মহিষকুণ্ডি (কুষ্টিয়া-নদীয়া) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও ২০১১ সালের জুনে উভয় দেশের সম্মতির ভিত্তিতে এ এলাকার সীমানারেখা বিদ্যমান সীমান্ত পিলার ১৫৩/১-এস থেকে টেনে মাথাভাঙ্গা নদীর তীর বরাবর ১৫৩/৯-এস নম্বর সীমান্ত পিলার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
বেরুবাড়ী (পঞ্চগড়-জলপাইগুড়ি) এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ১৯৯৬-১৯৯৮ সালে যৌথভাবে চিহ্নিত সীমান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশের অপদখলে থাকা বেরুবাড়ী (পঞ্চগড়-জলপাইগুড়ি) এবং ভারতের অপদখলে থাকা বেরুবাড়ী ও সিংঘাপাড়া-খুদিপাড়ার (পঞ্চগড়-জলপাইগুড়ি) সীমানারেখা আঁকা হবে।
প্রটোকলের অপদখলীয় ভূমি অংশে মেঘালয় সেক্টরের ছয়টি এলাকার উল্লেখ রয়েছে। পিরদিওয়া-পদুয়া এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, যৌথ জরিপ ও উভয়পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এ এলাকার সীমানারেখা ১২৭০/১-এস নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে ১২৭১/১-টি নম্বর পিলার পর্যন্ত টানা হবে।
ডাউকি/তামাবিল এলাকা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ১২৭৫/১-এস নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে ১২৭৫/৭-এস নম্বর সীমান্ত পর্যন্ত সীমান্তরেখা আঁকা হবে। উভয়পক্ষ এ সীমান্তের শূন্যরেখায় বেড়া দেওয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছে।
মুক্তাপুর-ডিবির হাওর এলাকা প্রসঙ্গে প্রটোকলে বলা হয়েছে, ভারতীয় নাগরিকরা এ এলাকার কালীমন্দির পরিদর্শন করতে পারবে। এছাড়া মুক্তাপুর এলাকার পাড় থেকে মুক্তাপুর/ডিবির হাওর এলাকার জলসীমানা থেকে ভারতীয় নাগরিকরা পানি উত্তোলন ও মাছ ধরতে পারবে।
‘ত্রিপুরা সেক্টর’ শিরোনামে ত্রিপুরা-মৌলভীবাজার সেক্টরের চন্দননগর-চম্পারাই চা বাগান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, এ এলাকার সীমানারেখা বিদ্যমান ১৯০৪ নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে সোনারিছড়া নদী বরাবর ১৯০৫ নম্বর পিলারে গিয়ে মিশবে।
প্রটোকলে ‘আসাম সেক্টর’ শিরোনামে কলাবাড়ী (বরইবাড়ী) এলাকা সম্পর্কে বলা হয়েছে, বিদ্যমান ১০৬৬/২৪-টি সীমান্ত পিলার থেকে সীমানারেখা টেনে ১০৬৭/১৬-টি নম্বর সীমান্ত পিলারে নিয়ে যাওয়া হবে। এ সেক্টরের পাল্লাথল এলাকার সীমান্তরেখা ১৩৭০/৩-এস নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে চা বাগানের বহিঃসীমানা বরাবর ১৩৭১/৬-এস নম্বর পিলার পর্যন্ত এবং ১৩৭২ নম্বর সীমান্ত পিলার থেকে চাষাবাদের এলাকার বহিঃসীমানা বরাবর ১৩৭২/২-এস নম্বর সীমান্ত পিলার পর্যন্ত টানা হবে।
২০১১ সালের প্রটোকলে বাংলাদেশের পক্ষে সই করা তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল সকালের খবরের কাছে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এটি অত্যন্ত সুখবর। যে প্রটোকল ২০১১ সালে হয়েছিল তা এখন চূড়ান্ত রূপ পাবে। আমাদের দীর্ঘদিনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার এই সফলতা। এটি দুই দেশের জন্যই লাভজনক।