[ads1]বাধাহীনভাবে একমুখী গাড়ি চলাচল। ২৬শ কিলোমিটার মূল সড়কে রিকশা চলবে না, চলবে সংযোগ সড়ক ও মহল্লা বা আবাসিক এলাকার রাস্তায়। দূরপাল্লার যানবাহনের টার্মিনাল, স্ট্যান্ড নগরের বাইরে। নগর পরিবহনের বাসে সিঁড়ি উঠিয়ে দিয়ে স্ট্যান্ডে প্ল্যাটফরম থাকবে। থাকবে ওভারহেড ইউ-টার্ন। সড়কে ট্র্যাফিক পুলিশ থাকবে না
আসাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলার দুটি ঘরজুড়ে ঢাকার রাস্তার মানচিত্র। ঘরের মেঝে আর টেবিলের ওপরও অনেক মানচিত্র। কিছু আছে ত্রিমাত্রিক মডেল। কম্পিউটারে আছে প্রকল্পের এনিমেশন। তিনি বললেন, ঢাকা যানজটমুক্ত করার মহাপরিকল্পনা এসব। জানতে চাই, এসবের জন্য খরচ কে দিয়েছে? বললেন, পুরোটাই নিজের পকেট থেকে এসেছে। সেই টাকার অংকটা কিন্তু কম নয়! নিজে থেকেই লেগে আছেন, গাঁটের পয়সা খরচ করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, এ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে ঢাকার মানুষ আরাম পাবে।[ads1]
পেছনের গল্প
একদিন দয়াগঞ্জের ট্রাফিক সিগন্যালে ট্রাফিক পুলিশ নিজেই ক্লান্ত হয়ে হাঁপাচ্ছেন। এই পথেই যাচ্ছিলেন আসাদুর রহমান। রিকশা থেকে নেমে গিয়ে তিনি যানবাহনের জট খোলার ‘সহজ রাস্তাটা’ বাতলে দিলেন ট্রাফিক পুলিশকে। সেই ট্রাফিক পুলিশ আসাদকে পরামর্শ দিলেন এই বিষয়টা কর্তা ব্যক্তিদের কাছে বলতে। কারণ আসাদ যে পদ্ধতিতে গাড়ি ঘুুরাতে ও রাস্তা যানজটমুুক্ত করার কথা বলেছেন সেই পদ্ধতি বেশ সহজ। তবে এটি সিটি করপোরেশনের প্রচলিত নিয়মের বাইরে। প্রস্তাবনা তৈরি করতে হবে। অফিসিয়ালি জমা দিতে হবে কার্যকরী করতে। শুরু করলেন সারা ঢাকার রাস্তা যানজটমুক্তকরণে মহাপরিকল্পনার কাজ।
সঙ্গী গাড়ি চালক
পুরনো ও অভিজ্ঞ গাড়ি ড্রাইভার জুলফিকার আলী তাদের পারিবারিক গাড়ির চালক। সেনাবাহিনীর ভারী গাড়ি চালাতেন। দেখেই বলে দিতে পারেন রাস্তার প্রস্থ কতটা আছে আর কতটা প্রয়োজন, কোন রাস্তায় কোন গাড়ি ঘুুরতে পারবে। জুলফিকার আলীকে নিয়ে ঘুরে বেড়ালেন সারা ঢাকা শহর। ঢাকার প্রতিটি পাড়া-মহল্লা ঘুরে ঘুরে তৈরি করলেন ‘ঢাকা ট্রান্সপোর্ট মহাপরিকল্পনা’। জুলফিকার আলী বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করলেন আসাদকে– রাস্তার কোন বাঁকে ইউ-টার্ন নিতে গাড়ির কতটুকু জায়গার প্রয়োজন পড়বে। কোন রাস্তা কতটুকু প্রশস্ত আছে আরও কতটা হওয়া প্রয়োজন, সব দেখে-শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন।
প্রস্তাবনা[ads1]
ঘুরে দেখার পালা শেষ। এবার প্রস্তাবনা বানালেন। ঢাকা নগরীর গাড়ির গতিপথ একমুখী করে যদি গাড়ি চলাচল নির্বিঘ্ন রাখা যায়, বাধাহীনভাবে গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করা যায় নগরে কোনো যানজট থাকবে না। মানুষের মূল্যবান কর্মঘণ্টাও বাঁচবে। তার পরিকল্পনামতে, ঢাকার প্রতিটি পথ হয়ে যাবে একমুখী। নগরের ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটার মূল রাস্তায় কোনো রিকশা চলাচল করবে না। সব রাস্তায় গাড়ি একদিকে চলাচল করবে। মহল্লা ও সংযোগ সড়কগুলোতে সাব-ট্রান্সপোর্ট হিসেবে রিকশা ও ছোট ছোট যান চলাচল করবে। দূরপাল্লার যানবাহনের জন্য টার্মিনাল ও স্ট্যান্ড নগরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। নগর পরিবহনের গাড়িগুলো যেখানে খুশি থেমে যাত্রী ওঠা-নামা করে। এতে প্রায় সময়ই যানজট লেগে যায়। এই সমস্যা দূরীকরণে তিনি গাড়িতে যে সিঁড়ি আছে তা উঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তার পরিকল্পনামতে গাড়ির সিঁড়ি উঠিয়ে দিয়ে গাড়ির স্টেশনে গাড়ির মেঝে বা ফ্লোর সমান উঁচু প্লাটফরম করে দিতে চাইলেও কেউ নির্দিষ্ট স্টেশন ব্যতিরেকে যত্রতত্র নামতে-উঠতে পারবে না। নগরের কিছু জায়গায় গাড়ির চলাচল একমুখীকরণের জন্য ওভারহেড ইউ-টার্নের ব্যবস্থা করতে হবে।
ট্রাফিকবিহীন সড়ক
সাধারণ রাস্তায় গাড়ি ইউটার্ন করাতে বিশেষ ডিজাইনের প্রয়োজন পড়বে। লক্ষণীয় বিষয় হল, রাস্তায় আর কোনো ট্রাফিক পুলিশের প্রয়োজন পড়বে না। রাস্তার ডিজাইন এমন হবে কেউ চাইলেই যে কোনো জায়গায় যানবাহন ঘুরাতে পারবে না, পরিকল্পিত প্রতিবন্ধকতার ফলে নির্ধারিত রাস্তায় গাড়ি চালাতে বাধ্য হবে মানুষ।
কঠিন যুদ্ধ[ads2]
অনেকের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। পরামর্শ নিলেন অনেকের। ২০১২ সালে তার প্রস্তাবনা জমা দিলেন ডিএমপি, যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও তত্কালীন ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন বোর্ড-ডিটিসিবি বর্তমান ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথিরিটি-ডিটিসি’র কাছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর বিশেষজ্ঞ প্রফেসর নজরুল ইসলাম, ডিএমপির ট্রাফিক পুলিশের তত্কালীন জয়েন্ট কমিশনার ব্যারিস্টার মাহবুবুল আলম একদিন ডেকে পাঠালেন আসাদুর রহমান মোল্লাকে। তার পদ্ধতির বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশদ আলাপ-আলোচনা করলেন। তার পরিকল্পনার প্রশংসা করলেন। তিনি জোর দিলেন এই পরিকল্পনার দুটি দিকের ওপর। প্রথমত, কোনো খরচ ছাড়া ও কম সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য। মাহবুবুল আলম জানান, তিনি ডিএমপিতে থাকাকালীন এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাবেন। কিন্তু হঠাত্ তিনি বদলি হয়ে চলে গেলেন ঢাকার বাইরে। আটকে গেল পরিকল্পনা।
বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক[ads1]
প্রথম থেকেই আসাদুর রহমান মোল্লার উদ্ভাবিত যানজটমুক্ত নগর-চিন্তার ভক্ত পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ। সালেহ উদ্দীন আগে থেকেই এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানেন। তিনি আসাদুর রহমান মোল্লার উদ্ভাবিত পরিকল্পনাটিকে বাস্তবসম্মত ও বৈজ্ঞানিক বলে অভিহিত করলেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে এই প্রজেক্ট চালু করার প্রস্তাব জমা দিলেন আসাদুর রহমান মোল্লা। পরিকল্পনা জমা দেয়ার প্রয়োজনে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে তৈরি করলেন ইউলুপ ডিজাইনসহ রোড ডিভাইডারের পূর্ণাঙ্গ নক্শা।
অবশেষে আলোর মুখ
মেয়রের নির্দেশে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন এবং ছোট-খাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি সমাধান করে সাতরাস্তা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত এই পরিকল্পনা চালু করার সিদ্ধান্ত হল। শিগগিরই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হক জানান, রাজধানীর হাতিরঝিলের সাতরাস্তা থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার সড়কের ৬৯টি রোড ক্রসিং বন্ধ করে ২২টি ইউলুপ তৈরি করে একমুখী যান চলাচল চালু করা হবে। এতে ঢাকার রাস্তার ২৫-৩০ শতাংশ যানজট কমে যাবে।
প্রক্রিয়া শেষ[ads1]
আনুষ্ঠানিক সকল প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। প্রকল্পের নাম দেয়া হয়েছে ‘সিগন্যাল-ফ্রি ট্রাফিক প্লান ফর জ্যাম-ফ্রি রোড ইন ঢাকা সিটি’। ২২টি ইউলুপের মধ্যে ১৩টি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন করবে। এগুলোর অনুমোদন হয়ে গেছে। বাকিগুলো করবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন। আসাদ ঢাকার ৯০ ভাগ রাস্তার এ্যানিমেশন তৈরি করে বিশেষজ্ঞদের দেখিয়েছেন। তার প্রকল্পে যানজট থেকে মুক্তির চারটি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- ওয়ান-ওয়ে, টু-ওয়ে, ইউলুপ এবং ওভার পাস বা আন্ডার পাস।
পুরস্কার
২০১৫ সালের ৮-১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ আয়োজন করে বিজ্ঞান ও শিল্প-প্রযুক্তি মেলা। ঢাকাকে যানজটমুক্তকরণের একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ‘স্বশিক্ষিত বিভাগে’ প্রথম স্থান অধিকার করেন আসাদুর রহমান মোল্লা। ঢাকা শহরের রাস্তার প্রতিটি ইঞ্চি পথ তিনি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তার পরেই এই মডেল তৈরি করেছেন।[ads2]